September 28, 2023
Movie Review

অন্তর্যাত্রা: আপন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সম্পর্ক ও সংস্কৃতির সন্ধান

অন্তর্যাত্রা

অন্তর্যাত্রা (2006) তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রটি আপন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সম্পর্ক ও সংস্কৃতির অন্বেষণ।

অন্তর্যাত্রা মুভি রিভিউঃ

অন্তর্যাত্রা চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র সোহেল। বাবার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর সোহেল শিশুকাল থেকে মায়ের সাথে লন্ডনে বাস করে। দেশ ও আত্মীয় স্বজন সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। মা সব কিছু থেকে তাকে আড়াল করে রেখেছিল। বাংলাদেশ তার কাছে পোর্স্টকার্ডের বেশি কিছু ছিল না। অনেকটা তার বাবার মতো, যিনি সোহেলের কাছে একটা ফ্রেমে বাধা ছবি মাত্র। বাবার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে লন্ডন থেকে কৈশোর পার করা সোহেল তার মা শিরিনের সাথে বাংলাদেশে আসে।

ঢাকা থেকে সিলেটে ট্রেনে যাওয়ার পথে সোহেল ডায়েরী লিখতে থাকে:
“অবশেষে এখন আমি বাংলাদেশে। ভাবিনি কখনও আসা হবে। এসে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন এই ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। আমার জনক…ঠিক বাবা ভাবতে পারি না…সে আজ মৃত অথচ ঠিক শোক অনুভব করছি না। কী করে করবো আমার কাছে সে অনেক আগেই মৃত। মা তাকে মৃত করেই রেখেছে। এতদিন এই নিয়ে প্রশ্ন তুলি নি। মেনে নিয়েছি-এটাই স্বাভাবিক। অনেক কিছুই আমি জানি না। আমি এখন সবকিছু জানতে চাই। অনেক কিছুই বুঝতে চাই।”

মাকে নিয়ে সিলেটে বাবার কুলখানিতে হাজির হয় সোহেল। পরিচয় হয় দাদা, ফুপু, ফুপা, বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী সালমা এবং তাদের মেয়ে রিনির সাথে। আর মৃত বাবার সাথে। বাবাকে নতুন করে অনুভব করে সোহেল। অনুভব করে জন্মভূমিকে। বাবার মৃত্যু শুধু তাকে নয়, মা’কেও বাবার কাছাকাছি এনে দিয়েছে, তাকে এখন বারবার এই দেশে ফিরে আসতে হবে।

অন্তর্যাত্রা
অন্তর্যাত্রা মুভির একটি দৃশ্য: আনুশাহের ফিউশন কীর্তন গান

সোহেল তার মধ্যে আকুতি অনুভব করে। সে নিজের শেকড়ের সন্ধান করে। তার সৎবোন রিনির সাথে ভাব জমে যায় এবং উপলব্ধি করে পরম্পরার শরিকানা, যার সাথে এই দেশ যুক্ত। তার দাদা তাকে বৈচিত্র্যময় সব অভিজ্ঞতায় ডুব দিতে সাহায্য করে, দেশ কী, দেশকে ঘিরে মানুষের আকুতি, বিহারি ও বৃটিশদের বিষয়াদি নিয়ে নাতির সাথে আলোচনা করে। সোহেলকে বৃটিশদের গোরস্থানে নিয়ে যান দাদা, কবর দেখান, সাত মাস বয়েসি বৃ্টিশ শিশুর কবর দেখান। মা, দাদা, ফুপু, ফুপার সম্পর্কের জটিল ‍দিকগুলো দেখেন সোহেল। কুলখানিতে দোয়া পড়া, কবরে গিয়ে দোয়া করা সোহেল এর আগে কখনো দেখেনি। আনুশাহ’র কীর্তন গান শুনে তার চোখ মুখ জ্বলে উঠে। আরো রয়েছে শিরিণের অতীতের স্মৃতিচারণ।

চলচ্চিত্রটির রূপকার তারেক মাসুদ এবং চিত্রনাট্যে তার সাথে আছেন ক্যাথরিন মাসুদ। অভিনয়ে করেছেন আব্দুল মোমেন চৌধুরী, সারা যাকের, রোকেয়া প্রাচী, রিফাকাত রশিদ, জয়ন্ত চট্রোপাধ্যায়, হেরল্ড রশিদ, লক্ষন, বিশেষ চরিত্রে বাংলা ব্যান্ডের আনুশাহ ও বুনো। সবার অভিনয় বেশ সাবলিল, স্বাভাবিক ও সতেজভাবে ফুটে উঠেছে। বিশেষ কোন জঞ্জালতা নেই। কিছু সিলেটি ভাষার ব্যবহার চমকপ্রদ ছিল। দৃশ্যায়ন ছিল অপূর্ব মনোরম।

সোহেলের বাবা রফিক’কে নিয়ে তার দুই স্ত্রী’র কিছু কথপোকথন বা ডায়লগঃ

শিরিণ: আপনাকে তুমি বলতে পারি?

সালমা: হুম, আপনি তো সবদিক থেকেই আমার বড়

শিরিণ: নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে আজ, বিশেষ করে ওর কাছে, বললে বিশ্বাস করবে কি না জানি না। খুব বড় মাপের মানুষ মনে করতাম ওকে। আমি জানিনা আমি কেন তোমাকে এসব কথা বলছি।

সালমা: আপনার বলতে ভাল লাগলে বলবেন।

শিরিণ: হয়ত অনেক আশা ছিল বলেই বিয়ের পড়ে হতাশ হতে শুরু করেছিলাম।
সালমা: থামলেন কেন?

শিরিণ: তুমি তো জান ইউনিভার্সিটিতে থাকতে ও পলিটিক্স করতো, সব ব্যাপারে ওর প্রগতিশীল ধ্যান ধারনা রিতিমতো মুগ্ধ করতে আমাকে।

সালমা: আপনি তো খুব ভাল গান করতেন, তাই না?
শিরিণ: ও বলেছে বুঝি?
সালমা: মঞ্চে খুব ভালো অভিনয় করতেন! তাও বলেছে।

শিরিণ: শুরুতে আমার গান, অভিনয় ও খুব এপ্রিশিয়েট করতো। কিন্তু আজকে মনে হয় ওসব কিছু নয়। ও হয়তো শুধু আমাকেই চেয়েছিলো, তাই বিয়ের পর যখন ও আস্তে আস্তে আমার গ্রুপ থিয়েটারে যাওয়া নিয়ে বাধ সাধলো তখন মনে হয়েছিল রফিক একজন কমপ্লিট হিপোক্রেট। প্রগতিশীল ধারনা ফারনা সব ফাকা বুলি। তবে এটাও হতে পারে তুমি যেভাবে ওকে বুঝতে পেরেছো, আমি সেভাবে বুঝতে পারিনি। হয়তো বোঝার চেষ্টাও করিনি।

সালমা: আমিও যে খুব একটা বুঝতে পেরেছিলাম, এমন দাবি করতে পারবো না। তবে একটা কথা বলতে পারি, ওর কাছে আমার তেমন একটা এক্সপেক্টেশন ছিল না। আমি তো ওর ছাত্রি ছিলাম। বিয়ের পরে আমাদের মাঝে ছাত্রি-শিক্ষক সম্পর্কটা রয়ে গিয়েছিল। আপনার মতো নিজেকে ওর সমকক্ষ ভাবার সুযোগ হয়নি কখনো। আর তাছাড়া আমি যখন ওকে পাই, ও তখন পরাজিত একজন বিধ্বস্ত মানুষ। সব সময় মনে হয়েছে আপনাকে ও ভুলতে পারেনি। নিজের ছেলেকে তো নয়ই। ও আজ নেই। তাই হয়তো এত সহজে আপনাকে এ কথাগুলো বলতে পারছি।

আরো মুভি রিভিউ দেখুন

অন্তর্যাত্রা’র মতো চলচ্চিত্র বাংলাদেশে খুব বেশী নেই। অসাধারণ এই ‘অন্তর্যাত্রা’ মুভিটি চলচ্চিত্র প্রেমিদের হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে থাকবে সাথে তারেক মাসুদ অমর হয়ে থাকবেন এর মাঝে।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x