অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা – বইটিতে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব, মুক্তিযুদ্ধ সমসাময়িক ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা করেছেন।
মেজর এম এ জলিল বইটিতে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব, মুক্তিযুদ্ধ সমসাময়িক, শেখ মুজিব ও আওয়ামীলীগের পদক্ষেপ, যুদ্ধের প্রকৃত রুপ, ভারতীয় বাহিনীর পরিকল্পিত ত্রাস ,বিরোধী শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধউত্তর আওয়ামীলীগের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির বাস্তবতা আলোচনা করা হয়েছে ৷ তার মধ্যে কিছু বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। সেগুলো যদি পর্যায়ক্রমে সাজানো হয় তাহলে এরকম দাঁড়ায়:
১. স্বাধীনতাপূর্ব ঘটনাপ্রবাহ
২. স্বাধীনতা যুদ্ধ ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব
৩. ভারতের মুখোশ উন্মোচন
৪. সংবিধান রচনা ও ভারতীয় অপপ্রভাব
তবে লেখকের পরিচয়টি সর্বাগ্রে দেয়া আবশ্যক। তাতে বোঝা যাবে কথাগুলো কে বলছেন। কিংবা সেগুলো কি আসলেই মূল্যায়নের দাবি রাখে।
মেজর এম এ জলিল; উপেক্ষিত অবজ্ঞাত সেনানী :
মেজর জলিলের জন্ম বরিশালের উজিরপুরে। ১৯৬৫ সালে পাক মিলিটারিতে কমিশন। যোগদান করেন ট্যাংক বাহিনীতে। পাক-ভারত যুদ্ধের একজন সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন জলিল। ১৯৭০ এ মেজর পদে উন্নীত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেব। নয় নম্বর সেক্টর ছিল মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তম সেক্টর। যার নেতৃত্বে ছিলেন এই সাহসী মেজর। সম্মুখযুদ্ধে একের পর এক জয়লাভ, সফল গেরিলা অভিযান এ লড়াকু সেনানীকে দেয় আন্তর্জাতিক পরিচিতি। প্রশংসিত হন বিবিসি সহ অনেক সংবাদ মাধ্যমে।
কিন্ত মুক্তিযুদ্ধে যার অসামান্য ভুমিকা স্বীকৃত হতে পারত সবার আগে তাকেই কেন যেন পেছনে ঠেলে দেয়া হয় অবজ্ঞাভরে। কারণ একটাই, তার চির প্রতিবাদী সত্তা। একাত্তরে ভারতীয় বাহিনী এ গরীব দেশ থেকে ত্রিশ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র সহ সম্পদ লুট করে। মেজর জলিল এ লুটাপাটের মহড়াকে বুলেট দিয়ে প্রতিরোধের হুমকি দিয়েছিলেন। যার ফলে তার স্বাধীন দেশে তাকেই বরণ করতে প্রথম কারাবরণ। আফসোস।
মেজর জলিল এরপরে যোগ দেন জাসদে। হয়েছিলেন দলের সভাপতি। জাসদ থেকে পদত্যাগের মাত্র 16দিন পর মেজর জলিল 1984 সালের 20 অক্টোবর ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ নামে একটি দল গঠন করেন। 1985 সালে তাকে গৃহবন্দী করা হয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি 1987 থেকে 1988 পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকেন।
এর আগে মেজর জলিল লিবিয়া, লেবানন, ব্রিটেন ও পাকিস্তানে কয়েকটি আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। 1988 সালের 19 নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইসলামাবাদের একটি ক্লিনিকে ইন্তেকাল করেন। মেজর জলিলই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যার লাশ দাফনের মাধ্যমেই মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা গোরস্থানে সর্বপ্রথম লাশ দাফন শুরু হয়েছে।
অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা রিভিউ
ফ্ল্যাপের কথা :
“ স্বাধীনতা লাভের প্রায় ১৭ বছর পরেও আমাদের কোন অভাব দূর তো হ’লই না, বরং যত দিন যাচ্ছে ততই যেন জাতি হিসেবে আমরা মর্যাদাহীন হয়ে পড়ছি, নিস্তেজ হয়ে পড়ছি ৷ বুক ভরা আশা স্বপ্ন আজ রূপান্তরিত হয়েছে গ্লানি ও হতাশায় ৷ সম্মান, জাতীয়তাবোধ, মর্যাদাবোধ, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ এ সব কিছুই যেন বিধ্বস্ত ৷ এক কথায়, বিবেক আজ বিভ্রান্ত ৷ সুবিধাবাদ এবং অযোগ্যতার মহড়ায় গোটা জাতি আজ নীরব নিশ্চল অসহায় জিম্মী ৷ ”
১. স্বাধীনতাপূর্ব ঘটনাপ্রবাহ
সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। অভিযোগ ওঠে, এই বিজয়ে হাত ছিল ভারতের। সাতচল্লিশের পার্টিশনে দেশ ছেড়ে যাওয়া হিন্দুরা বাংলাদেশে এসে নাকি ভোট দিয়েছিল এ নির্বাচনে। তবে মেজর জলিল স্বীকার করেছেন এসব কথার সত্যতা তলিয়ে দেখা হয়নি।
৭ই মার্চ জ্বালাময়ী ভাষণ দেন শেখ সাহেব। অথচ ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এর ডাক দিয়েও তিনি ছিলেন সমঝোতার আশায়। বসতে চাচ্ছিলেন পাক সরকারের সাথে আলোচনায়। শেখ সাহেব একদিকে স্বাধীনতাকামী ছাত্র নেতাদের সামাল দিয়ে অপর দিকে পাকিস্তানের সাথে আপশে আসতে চাচ্ছিলেন। মেজর জলিল বলেন, ‘তার এ স্ববিরোধী ভূমিকার জন্য ইতিহাস তাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করালে তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না’।
২. স্বাধীনতা যুদ্ধ ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে আওয়ামীলীগ নেতারা দলবেধে ভারতে হিজরত করেন। এদেশে তরুণ যুবকদের তাজা রক্তে জমিন রাঙা হয়ে উঠছিল যখন স্বাধীনতার চেতনাধারী লীগাররা কোথায় ছিলেন এ প্রশ্ম তুলেছেন অনেকেই। তারা মুজিবনগরে সরকার প্রতিষ্ঠা করেই খালাস। শত মা-বোনের সম্ভ্রমহানী, হাজার যুবকের প্রাণবায়ু যে বাতাসে হাহাকার করে বেড়ায় সে দেশ ছেড়ে পরদেশে কি করছিলেন আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভা?
প্রকৃত দেশপ্রেম থাকলে ৮ নাম্বার থিয়েটার রোডে না থেকে তারা থাকতে পারতেন কোন গেরিলা যুদ্ধের সামনের কাতারে। কিন্ত তারা তা থাকেননি। তারা ৫৬/এ, বালিগঞ্জের দোতাল বাড়িতে বসে বসে তাস খেলে দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখেছেন। মেজর জলিল ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এসব দেখে বলেছিলেন,
‘যে জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ জনগণকে যুদ্ধের লেলিহান শিখার মধ্যে নিক্ষেপ করে বেকার, অলস যুবকদের মত তাস খেলায় মত্ত হতে পারে সে জাতির দুর্ভাগ্য সহজে মোচন হবার নয়’।
মেজর জলিল অস্ত্র সরবারহের জন্য ভারতে যান এপ্রিল মাসে। সাক্ষাৎ করেন জেনারেল অরোরার সাথে। প্রথম সাক্ষাতে বিশ্বাসযোগ্যতা পেলেন না। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে পরিচয় প্রমাণ করতে জেনারেল অরোরাকে তাজউদ্দীন ও ওসমানী সাহেবের রেফারেন্স দিয়েছিলেন। জেনারেল এই দুই মহান নেতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ঐ দু’টি ব্লাডি ইঁদুরের কথা আমি জানি না। অন্য কোন স্বাক্ষী থাকলে নিয়ে আস।’ এরপর তার ‘মেজর’ পরিচয় জেনে ভারতীয় বাহিনী তাকে ইন্টিলিজেন্স এজেন্টের মাধ্যমে জেরা করে। উদ্দেশ্য পাকিস্তান আর্মির গোমর বের করা। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রদান নয় পাক বাহিনী সম্পর্কে তথ্য নেয়াই ছিল ভারতীয় বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য।
মেজর জলিল কলকাতায় বালিগঞ্জের আবাসিক এলাকার বাড়িতে গিয়ে দেখেন প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রীসভা নিয়ে (মোস্তাক ছিলেন না সেখানে) তাস খেলছেন। ওসমানী সাহেব সম্মানিত বন্দীর জীবন যাপন ছাড়া কিছুই করতেন না। সবাই ছিল ভারতের হাতে জিম্মির মত।
ভারতে হিজরতকারীরা জড়িয়েছিলেন যৌন কেলেঙ্কারিতেও। জহির রায়হান জানতেন তার অনেকাংশই। মেজর জলিল লিখেছেন,
‘ভারতে অবস্থানকালে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার গঠনের পর এর সমগ্র গঠনতন্ত্র যখন কলকাতা কেন্দ্রিক পরিচালিত হচ্ছে তখন জহির রায়হার কলকাতায় যান ৷ তিনি জেনেছিলেন অনেক কিছু, চিত্রায়িতও করেছিলেন অনেক দুর্লভ দৃশ্যের। কিন্ত অতসব জানতে গিয়েই বেজায় অপরাধ করে ফেলেছিলেন। … ভারতের মাটিতে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের চুরি-দুর্নীতি, অবৈধ ব্যবসা, যৌন কেলেঙ্কারি, বিভিন্ন ভোগ-বিলাসসহ তাদের অপকর্মের প্রচুর প্রামাণ্য দলিল ছিল – ছিল সচিত্র দৃশ্য।’
বাংলাদেশ রক্তের ঋণ: সত্য কল্পকাহিনি থেকে অদ্ভুত
মেজর জলিল আরও লিখেছেন,
‘শরণার্থী শিবির থেকে অসহায় যুবতী হিন্দু মেয়েদের কোলকাতা শহরে চাকরি দেবার নাম করে সেই সকল আশ্রয়হীনা যুবতীদের কোলকাতার বিভিন্ন হোটেলে এনে যৌন তৃষ্ণা মিটাতে বিবেকে দংশন বোধ করেন নি। তারা বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের নেতা হবে না তো হবে আর কে বা কারা! হানাদার পাক বাহিনীর একমাত্র যোগ্য উত্তরসূরি তো তারাই – আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ!
৩. ভারতের মুখোশ উন্মোচন
মেজর জলিল সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যখন মুজিবনগর সরকারের কাছে রসদ, অস্ত্র সাহায্য চেয়েছেন প্রতিবারই ভোগান্তিতে পরেছেন ৷ এমনকি ভারতীয় মিত্রসেনাদের হাতে ঘরবন্দি হয়েছেন ৷
যে ভারতীয় বাহিনী গেরিলা যোদ্ধাদের পেছনের সারিতে থেকে পাক সেনাদের বুলেট থেকে বাঁচতে ছিল সদা সপ্রতিভ ১৬ ই ডিসেম্বর তারাই যেন হটাৎ করে সামনের কাতারে চলে আসে।
মুক্তিযুদ্ধকে দেয়া হল পাক ভারত যুদ্ধের রূপ। কি জঘন্য মিথ্যাচার! আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কর্নেল ওসমানীকে ভারত থেকে আসার অনুমতি দেয়া হল না। প্রশ্ন উঠেছিল ভারত সরকার কি তাকে রাজবন্দী হিসেবে আটকে রেখেছিল কি না?
চুক্তি স্বাক্ষরিত হল অরোরা আর নিয়াজীর মধ্যে। অথচ বাংলাদেশ আর্মির অনেক সেক্টর কমান্ডার সহ অনেকেই ছিলেন সেখানে। বৃথা গেল আমাদের কষ্টার্জিত বিজয়। ইতিহাস স্বীকার করে নিয়েছে এ বিজয় ভারতের। এ পাক-ভারত যুদ্ধ। বাংলার সাহসী সন্তানদের এখানে কিইবা কৃতিত্ব!
শুধু বিজয়ের কৃতিত্ব লুট কর ক্ষ্যান্ত হয়নি ভারতীয় বাহিনী। শুরু করে লুটপাটের মহড়া। ট্রাকের পর ট্রাক অস্ত্র পাচার করা হয় ওপারে। বাথরুমের আয়নাও রেহাই পায়নি লুটেরাদের ছোবল থেকে। প্রাইভেট কারগুলো রক্ষা করতে মেজর জলিল সব গাড়ি রিকুইজিশন করে সংরক্ষণ করেন।
খুলনা ও আশেপাশের এলাকার চার্জে ছিলেন ভারতীয় জেনারেল দালবীর। মেজর জলিল তাকে তার লুটপাটের জন্য হুমকি দিয়ে পাঠান – দেখা মাত্রই গুলি করা হবে। কিন্ত তার পরিণতি মোটেও সুখকর হয়নি। ৩১শে ডিসেম্বর তাকে করা হয় গ্রেফতার।
বাংলাদেশের 5টি বিখ্যাত নন-ফিকশন বই | সত্য কল্পকাহিনী থেকেও রোমাঞ্চকর।
বইটা মূলত ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের ঘটনার বর্ননার জন্যই বেশি বিখ্যাত। একই সাথে যুদ্ধের সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারেরও প্রচুর সমালোচনা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আসলে কি বুঝায় বা যে চেতনার কথা বলা হয় সেই সকল কাদের থেকে সৃস্টি এসব নিয়েই কথা বলেছেন জোড়ালো ভাবে।
তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বলে পরিচিত দলের নেতা কর্মীদের যুদ্ধকালীন সময়ে ভূমিকা লেখক স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। এবং ভারতীয়রা ঠিক কি কারনে এদেশের স্বাধীনতায় সাহায্য করেছে তা ও ব্যাখা করেছেন এই বইতে।