“আগুনপাখি” হাসান আজিজুল হক এর দ্বিতীয় উপন্যাস। উপন্যাসটি বর্ধমান জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবার ও পরিবারের পার্শ্ববর্তী হিন্দু-মুসলমানদের জীবন থেকে নেওয়া।
আগুনপাখি উপন্যাস’টির কেন্দ্রীয় চরিত্রে একটি রক্ষণশীল মুসলিম একান্নবর্তী পরিবারের এক সাধাসিধে গৃহবধূ তার বাল্য থেকে বৃদ্ধাপ্রায় জীবনের ছোট-বড় ঘটনাগুলো নিজস্ব আঞ্চলিক রাঢ় ভাষায় নিতান্ত সরল ভাবনাতেই বর্ণনা করেছেন। তাঁর শাশুরীসহ স্বামীরা পাঁচ ভাই, তাদের বউ-ছেলে-মেয়ে এবং একটি বাল্যবিধবা বোন। এই বড় পরিবারের নেতৃত্ব দিতেন গিন্নি শাশুরী, তার মৃত্যুর পরে বিধবা বোন গিন্নির উপর দায়িত্ব পড়ে, তার কথাতেই সবকিছু হতো। আর তার স্বামী পরিবারের কর্তা তাঁর পিতার মৃত্যুর পর নুয়ে পড়া সংসারটিকে তিলতিল করে গড়ে তুলেছিলেন, শুধু তাই নয় একশবিঘে জমি করেছিলেন, পুরনো আভিজাত্যকে ফিরিয়ে আনারও চেষ্টা করেছেন এবং আনছেনও।
হাসান আজিজুল হক এর ‘আগুনপাখি’ উপন্যাস রিভিউ
নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ছিলেন অনড় ও অনিবার্যপ্রায় অবলম্বন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ প্রেক্ষাপটে মানুষ যখন পর্যদস্তু, যখন অনেক মানুষ অনাহারে মৃত ও মৃতপথগ্রস্থ; তখনও সংসারকে প্রায় পূর্ণতাই এসবের থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। তেঁতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের পরপর তাদের যৌথ মায়ার পরিবার ভেঙে ভাইদের হাঁড়ি আলাদা হলে কথকের বুকের ভেতর শুনতে পায় সাহারার তপ্ত-হাহাকার।
চতুর্দিকের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার যে প্রভাব তাকে ক্রমনিয়ত বিচলিত করেছে, বিষন্ন করেছে, সংসারে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষপাতী নারীটি তার দ্বিধার কথা নিশিথে নিভৃতে তার কর্তাকে বলেছে, বুঝতে চেয়েছে প্রশ্ন করে..তার এ প্রশ্নের উত্তর যেমন দিতে পারেনি তার কর্তা, সন্তানেরা, তেমনি এ প্রশ্নের উত্তর নেই ভারত ভেঙে ভাগ করা বুড়ো খোকাদের কাছেও!
উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি
“একই দ্যাশ, একইরকম মানুষ, একইরকম কথা, শুধু ধম্মো আলেদা, সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদিন হয়? এক লাগোয়া মাটি, ইদিকে একটি আমগাছ, একটি তালগাছ! তারা দুটো আলেদা দ্যাশের হয়ে গেল? কই ঐখানটোয় আসমান তো দুরকম লয়।
আগুনপাখি – হাসান আজিজুল হক
জীবন ঘষে আগুন – হাসান আজিজুল হক
চারাগাছ এক জয়গায় থেকে আর জায়গায় লাগাইলে হয়, এক দ্যাশ থেকে আর দ্যাশে লাগাইলেও বোধায় হয়, কিন্তুক গাছ বুড়িয়ে গেলে আর কিছুতেই ভিন্ মাটিতে বাঁচে না।
আগুনপাখি – হাসান আজিজুল হক
দেশভাগের পর স্বামী, সন্তান পূর্ব-পাকিস্তানে চলে যান আর তিনি একা থেকে যান প্রিয় ভিটাবাড়িতে এবং এক রাতের অশ্রুনদীতে ভেসে, বিপুল বিষন্নতা শেষে পুনরায় জেগে উঠতে চান। বলেন,
সকাল হোক, আলো ফুটুক, তখন পুবদিকে মুখ করে বসব। সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াব আমি। আমি একা।
শেষ কথা
শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য আর আপন জাতিত্বের অস্তিত্বের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকলে আগুন পাখির মতো উপন্যাস লেখা তো দূরের কথা, পড়াও যায় না। এমন কি পড়া আরম্ভ করলেও শেষ করা যায় না, যদি জীবনের ভেতরের জীবনে, ইতিহাসের ভেতরের ইতিহাসে, অন্তরের ভেতরের অন্তরে ডুব দেওয়ার কোনো পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকে। রাজনীতির ভেতরের রাজনীতিতে, সমাজের ভেতরের সমাজে, পরিবারের ভেতরের পরিবারে, জীবনের ভেতরের জীবনে, হৃদয়ের ভেতরের হৃদয়ের রহস্য উদ্ঘাটনের দক্ষ ডুবুরি হাসান হাসান আজিজুল হক আদায় করে নিলেন সংস্কৃতিবোধ সম্পন্ন অগণিত বাঙালির স্যালুট!