একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ নামক বইটিতে ৭৫ এ নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতেই লেখক ‘কর্নেল শাফায়াত জামিল, (অব:)’ বইটি লিখেছেন, বইটি পড়লে এটাই সর্বাগ্রে মনে হবে।
প্রথমে, লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম. এ হামিদ রচিত ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইয়ে কর্নেল শাফায়াত জামিলকে নিয়ে বলা কিছু কথা উল্লেখ করছিঃ
লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম. এ হামিদ এর লেখা ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইয়ে আলোচ্য বইয়ের লেখক কর্ণেল শাফায়াত জামিল এর ট্রুপ দ্বারা 15অগাষ্ট ভোর বেলা তার আক্রান্ত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সারা সকাল বেলা রশিদ, ডালিমরা, এমনকি ফারুকও তার এরিয়ায় খোলামেলা হাসিখুশি ঘোরাফেরা করছিল। শাফায়াত তার এরিয়াতে চার হাজার সৈন্য নিয়ে কেন তাদের ঘেরাও করতে পারলো না? চরম মুহূর্তে চার হাজার সৈন্য নিয়ে শাফায়াত নিস্ক্রিয় বসে থাকলো। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান আক্রান্ত হয়েছেন জেনেও নিজে থেকে সে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তাই উপলব্ধি করলো না। শাফায়াতের এই নিস্ক্রিয়তা ছিল ইচ্ছাকৃত, নাকি অনিচ্ছাকৃত?
15 আগস্ট, 1975 সালে ভোর 5.50 মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার বাসায় হত্যা করা হয়। হত্যার কিছুক্ষন আগে শেখ সাহেব সেনা প্রধান শফিউল্লাহ’কে ফোনে বললেন; ‘শফিউল্লাহ, আমার বাসা তোমার ফোর্স অ্যাটাক করেছে। কামালকে হয়তো মেরেই ফেলেছে। তুমি তাড়াতাড়ি ফোর্স পাঠাও ।’
শফিউল্লাহ বললেন, ‘স্যার, Can you get-out, I am doing something.’ এরপর ফোনে আর শেখ সাহেবের সাড়া পাওয়া যায়নি। শফিউল্লাহ ফোনে গোলাগুলির শব্দ পান। তখন সকাল আনুমানিক 5-50মিনিট।
শফিউল্লাহ বিভিন্ন দিকে ফোন করতে থাকে। প্রথমেই তিনি ফোন করেন 46 ব্রিগেড কমান্ডার কর্ণেল শাফায়াত জামিলকে। শফিউল্লাহ অবশ্য শাফায়াত জামিলকে বেশ কিছুক্ষন আগেই সোয়া 5টার দিকে ট্রুপস মুভ করতে বলেছিলেন, কারণ ধানমন্ডির দিকে ট্যাংক মুভমেন্টের খবর তিনি আনুমানিক সোয়া 5টার দিকে গোয়েন্দা মারফত অবগত হন। কিন্তু তার নির্দেশ সত্বেও শাফায়াত জামিল তখন কোন অ্যাকশন নেয়নি।
অন্যদিকে শাফায়াত জামিল বলেছে, ‘শফিউল্লাহ আমাকে কোন নির্দেশ দেননি। তিনি শুধু বিড়বিড় করেছেন, কেদেঁছেন। কোন অ্যাকশন নিতে বলেননি।’
শফিউল্লাহ সাফায়াতকে আবার ফোন করেন, কিন্তু রিসিভার তুলে রাখায় তাকে পাওয়া যায়নি।
ঢাকার পদাতিক ব্রিগেড কমান্ডার কর্ণেল সাফায়াত জামিল, তার অধীনে ছিল 4000 হাজার সৈন্য। শাফায়াত একজন Independent ব্রিগেড কমান্ডার। বঙ্গবন্ধুর একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত কমান্ডার হিসাবেই কর্ণেল শাফায়াতের হাতে তিনি ঢাকার পদাতিক ব্রিগেডের পরিচালনা ভার ন্যস্ত করে নিশ্চিত থাকেন। অথচ 15ই অগাষ্ট ভোর বেলা তার ট্রুপ দ্বারা আক্রান্ত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শাফায়াত ভোরবেলা আনুমানিক 5-30 ঘটিকায় আক্রমনের খবর পাওয়া সত্বেও তার সৈন্যদের নিরস্ত্র করার বা ফিরিয়ে আনার কোন ব্যবস্থাই গ্রহন করেননি। বরং এখানে ওখানে ঘুরে সময় নষ্ট করে এবং সেনা প্রধানকে এড়িয়ে, সে জিয়াউর রহমানের দিকে যায় নির্দেশ নিতে।
তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা বইয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে শাফায়েত জামিল ক্যুর বিষয়ে অবগত ছিলেন এবং যথেষ্ট সময় এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ফারুক গংদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। বইটির লেখক এম. এ হামিদ এক সাক্ষাতকারে যখন ফারুক-রশিদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন শাফায়েত এ বিষয়ে কিছু জানেন কিনা তখন রশিদ মুচকি হেসে হেয়ালি উত্তর দিয়েছিল, সে তো আমাদেরই লোক।
– লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম. এ হামিদ, তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর রিভিউ
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে কিংবদন্তিসম খ্যাতি-অর্জনকারী বীরযোদ্ধা শাফায়াত জামিল, লড়াইয়ের ময়দানে অকুতোভয় বীর। তার সাহসিকতার জন্য তাকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করা হয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ড এবং নভেম্বরে বিপ্লবী চক্রান্তে চার জাতীয় নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যায় ব্যথিচিত্তে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন আরো বেশি।
লেখক বইটির প্রথম অধ্যায়ে একাত্তরে তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত ও সম্মুখ যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন। সাথে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম.জি ওসমানি সাহেবের কথা এবং ভারতের গুর্খা রেজিমেন্টের আমাদের মাতৃভুমির জন্য আত্মত্যাগ ইত্যাদি।
লেখক বইটির 2য় ও 3য় অধ্যায়ে 15অগাষ্টে নির্মম নিষ্ঠুর হত্যালীলার বিবরণ, যে-ঘটনাধারা অত্যন্ত কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি এবং পরবর্তী 3রা ও 7ই নভেম্বর পর্যন্ত ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এ অধ্যায়ে বিশেষ কিছু বিষয়ের অবতারনা করেছেন, সুবিধাবাদি কিছু বাঙ্গালী সেনা অফিসারের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের সাথে বেইমানীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের দ্বারা মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারের প্রান হারানোর বিষয় রয়েছে। খন্দকার মোশতাক গংদের মুখোশও হালকাভাবে তুলে ধরেছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর একমাত্র প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসাবে আওয়ামি নেতা তোফায়েল আহমদের কথা বলেছেন, তার ব্যক্তিত্ব ও আনুগত্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন লেখক।
এরশাদ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা এবং পরবর্তীতে অতি দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে জেনারেল এরশাদ সাহেবের সামরিক বাহিনীতে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার ইঙ্গিত দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য শাফায়েত চরমভাবে সমালোচনা করেছেন এরশাদের।
জেনারেল জিয়াউর রহমানের অবস্থান সম্পর্কে লেখক কখনো তাকে ইতিবাচক আবার কোথাও নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছেন। জিয়ার অবস্থানকে খুব বেশি পরিষ্কার করেননি তিনি, হয়তো রাজনৈতিক কারনে।
পরিশেষে, লেখক 15অগাষ্ট এ নিজের অবস্থান কতটা পরিস্কার করতে পেরেছেন এ বইতে বা কৈফিয়ত দিতে পেরেছেন, তা গভীর বিশ্লেষণের দাবী রাখে। তাছাড়া লেখক দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেনাবাহিনীর ভিতরে বাহিরে যে রাজনৈতিক নোংরা খেলা চলছিল এবং কতিপয় সেনাবাহিনীর অফিসার নিজেদের দেশবিধাতারূপে প্রকাশ করে, দেশকে নেতা শুন্য করার যে নোংরা চিন্তা ভাবনা করেছেন, তার রগরগে বর্ণনা দিয়েছেন এই বইতে। বইটি নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ঘৃণ্য হত্যাকান্ডের ইতিহাস জানতে সাহায্য করবে।
তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা বইয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে শাফায়েত জামিল 15আগস্ট, 1975 এ ক্যুর বিষয়ে অবগত ছিলেন এবং যথেষ্ট সময় এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও খুনী ফারুক গংদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। বইটি পড়ে আমার মনে হল তিনি ‘৭৫ এ নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতেই বইটা লিখেছেন। সব মিলিয়ে বইটি সুপাঠ্য, বাংলাদেশের কালো রাজনীতির বিপুলা রহস্যের কিছুটা হয়ত অনাবৃত করতে পারে বইটি। যারা পরতে যান, রিকমেন্ডেড।
বইটি রকমারি থেকে কিনতে পারবেন