গাভী বিত্তান্ত বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও লেখক আহমদ ছফা রচিত একটি বাস্তবিক গভীর পর্যবেক্ষণে রচিত উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। গাভী বিত্তান্ত উপন্যাসে চিত্রায়িত হয়েছে একজন উপাচার্যের গোলামি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির নোংরা কদর্য রূপ।
গাভী বিত্তান্ত উপন্যাস রিভিউঃ
মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ চুপচাপ গোবেচারা ধরণের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যাকে নিয়েই পুরো গল্পটি। তিনি স্বভাবের দিক দিয়ে এত নিরীহ ছিলেন যে তাঁর সঙ্গে শত্রুতা করলে অনেকে মনে করতেন, শত্রুতা করার ক্ষমতাটির বাজে খরচ করা হবে। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় তাঁর বন্ধু বা শত্রু কেউ ছিল না।
দেশের সবচাইতে প্রাচীন এবং সবচাইতে সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি হাল আমলে এমন এক রণচণ্ডী রুপ নিয়েছে। যেখানে ধন প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকা নিরাপদ নয়। এখানে মিছিলের গর্জন কানে ঝিম ধরিয়ে দেয়। দুই দলের বন্দুক যুদ্ধে পুলিশ আসলে তিন দলের বন্দুক যুদ্ধে পরিনত হয়। চীনা কুড়াল দিয়ে বন্ধুদের হাত-পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলতো পেশাদার কশাইদের চেয়েও দক্ষতায়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কোন কাজ সহজে হত না । সহজে ভর্তি হওয়ার উপায় নেই, সহজে পাস করে বেরিয়ে যাবে সেপথ একরকম বন্ধ। এখানকার জীবন প্রবাহের প্রক্রিয়াটাই জটিল। কোন শিক্ষক অবসর নিলে, তাঁর বাসাটি দখল করার জন্য কে কাকে ল্যাঙ মারবে সেই চেষ্টা তদবির চলতে থাকে। পরীক্ষার খাতা দেখা নিয়ে চলে ঠাণ্ডা যুদ্ধ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেগা সূচাগ্র মেদিনী’ এটা একটা রীতি হয়ে গিয়েছিল।
সেখানে মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ বিনা প্রয়াসে এক রকম স্বপ্ন দেখতে দেখতে উপাচার্যের আসনটি দখল করে বসেছেন। যা সকলকে বিস্ময়াবিষ্ট করে ছেড়েছে। আবু জুনায়েদ স্বয়ং বিস্মিত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। আবু জুনায়েদের স্ত্রী নুরুন্নাহার বানু আণ্ডা মুরগির মতো চিৎকার করে সকলের কাছে বলে বেড়াতে লাগলেন যে তাঁর ভাগ্যেই আবু জুনায়েদ এমন এক লাফে অত উচুঁ জায়গায় উঠতে পারলেন। নুরুন্নাহার বানু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বেগম। সতীর ভাগ্যে পতির জয়। তারপরেও ভাগ্যচক্রের হাতিটি কোন পথ দিয়ে আবু জুনায়েদকে পিঠে করে বয়ে এনে এই অত্যুচ্চ আসনে বসাল তারই ব্যাখা আহমদ ছফা এই ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসে দিয়েছেন।
ব্রিটিশ স্থাপত্যের সুন্দর নিদর্শন উপাচার্য ভবনটিতে নুরুন্নাহার বানু, কলেজগামী কন্যা এবং ছোকড়া চাকরসহ উঠে আসার পর মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ পূর্বে চিন্তা করেননি এমন কতিপয় অসুবিধের সম্মূখীন হতে থাকলেন। নিজেকে মনে প্রাণে বদলে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। স্যুট টাই ও কাপড়চোপড় দিয়ে নিজের ওপর আস্থার অভাব চাপা দেয়ার চেষ্টার ত্রুটি করছেন না। আবু জুনায়েদ খুব সকালে পাঁচটার দিকে ঘুম থেকে উঠেই এক চক্কর হেঁটে আসেন। মেজাজ ভালো থাকলে কোনোদিন ফজরের নামাজটা পড়ে ফেলতেন। গোসল সারার পর নাস্তা খেতে বসতেন। পত্রিকায় চোখ বুলোতেন। তারপর ধীরে-সুস্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেন। এ সময় নুরুন্নাহার বানু চটাচটি করলে তিনি মেজাজ খারাপ করতেন না। আবার দেড়টা বা দুইটার দিকে ফিরে আসতেন।
আবু জুনায়েদের খুব শখ ছিল একটা গাভী পুষবেন। সে কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডারের কাজ করেন শেখ তবারক আলী জানতে পেরে তার জামাতাকে দিয়ে দুদিনের মধ্যেই সাত-আটজন মিস্ত্রি দিয়ে ইট-সিমেন্ট, রড বালু দিয়ে দশ বাই বার ফিটের একটি গোয়াল ঘর পাশে লাগোয়া একটি টিনের শেড যেখানে দিনের বেলা গাভীটি থাকবে এবং গোয়ালঘরের পাশে কিছুটা সময় ব্যয় করতে পারেন, সেজন্য আরো একটা শেড নির্মাণ করে দিল। আবু জুনায়েদ তো বিস্ময়ে হতবাক। অবশেষে অপূর্ব সুন্দর উজ্জ্বল লাল রঙ মাঝে-মাঝে ডোরা কাটা দাগের গরুটি গোয়াল ঘরে আসলো। উপাচার্য সাহেব গরুর পিঠে হাত রাখলেন, ইচ্ছে হলো ওলানটা একটু ধরে দেখবেন। স্ত্রী এবং কন্যার সামনে সেটি সম্ভব হলো না। গরুটি নাম দিল তরণী। গোয়াল ঘরটির নাম হলো তরণী নিবাস। [গাভী বিত্তান্ত]
আবু জুনায়েদ অতিশয় কর্মব্যস্ত মানুষ। কোথাও খুন, ভাঙচুর, কোথাও না কোথাও একটা ঘাপলা প্রতিদিন লেগেই থাকে। সরকারের মন্ত্রিমহোদয় চোখ রাঙাচ্ছেন, বিরোধী দলের হুঙ্কার, সবকিছু আবু জুনায়েদকেই বইতে হচ্ছে। সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। চারদিকে অসন্তোষ সমালোচনা। প্রাক্তন উপাচার্যের পাঁচ বছরের চেয়ে আবু জনুয়ায়েদ পাঁচ মাসে দুগুন অনিয়ম করে ফেলছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়া সত্ত্বেও নিজের মতামত আরোপ করতে পারতেন না। তিনি একটা যন্ত্রে পরিনত হয়েছেন। তিনি কিছুই করছেন না, তাঁকে দিয়ে করিয়ে নেয়া হচ্ছে। তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনোও মূল্য নেই। মন খুলে কথা বলার মত তার কোন বন্ধু নাই। নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গে তার কোন রকম ভাব বিনিময় সম্ভব নয়। নুরুন্নাহার জুতোর হিলের উচ্চতা বৃদ্ধি করেই যাচ্ছেন। রুপ চর্চায় মেয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাঁচা হলুদ, মশুর ডাল বাটা এসব মাখেন। যখন তখন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান, আবু জুনায়েদ প্রয়োজনের সময়ও গাড়ি পান না। [গাভী বিত্তান্ত]
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক: নিভৃত এক কিংবদন্তি
ভেতর বাইরে দুদিকের চাপ যখন প্রবল হয়ে ওঠে, আবু জনুায়েদ তরণী নিবাসে গরুটির কাছে ছুটে যান। ক্রমাগত আসা যাওয়ার ফলে গরুটি তাকে চিনে ফেলেছে। তিনি যখন গরুটির সামনে যান তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। আবু জুনায়েদ যে খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে গরুটি বুঝতে পারে। তরণীর কাছে যতক্ষন থাকেন তিনি ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হয়ে যান। গোয়াল ঘরটির উত্তর দিকের শেডে এখন নিয়মিত সান্ধ্য আড্ডা বসে। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবু জুনায়েদের গোয়ালঘর নিরন্তর কর্মতৎপরতার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াল। শধু সন্ধ্যেবেলা নয়, ছুটির দিনে, কর্মবিরতির দিনে, ধর্মঘটের দিনগুলোতে এ গোয়ালঘরে নারাকম বৈঠক বসা শুরু হয়ে গেল। বাদ প্রতিবাদ, বাকযুদ্ধ, লিফলেট, পাল্টা লিফলেট বিতরনের মধ্যে আবু জুনায়েদের গরুটির কথাই সর্বাদিক প্রচার হলো। ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে উপাচার্যের গাভী একটা চমৎকার শ্লেষাত্মক শব্দ হিসেবে পরিচিত পেয়ে গেল। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি পর্যন্ত হচ্ছে।
নুরুন্নাহারের ধারনা এই গরুটি আসার পরে আবু জুনায়েদ তার প্রতি আগের চেয়েও নিস্পৃহ হয়ে পড়েছেন। হিংসাত্মক কারনে গাভীটিকে খড়কুটোর সাথে বিষ মিশিয়ে নির্দ্বিধায় হত্যা করেন।
গাভী বিত্তান্ত হাল আমলের বাস্তব প্রেক্ষাপটে রচনা করেছেন আহমদ ছফা। উপন্যাসটি একেবারে আনকোরা নতুন স্বাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ে লেখা এটি একমাত্র উপন্যাস। বেদনা ও মমত্তবোধের কারণে উপন্যাসটি কোথাও কোথাও সমুদ্রের গভীরতা অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্পণে দেশ সমাজ এবং জাতিকে নিরীক্ষণের মহামূল্য প্রমান হিসেবেও ‘গাভী বিত্তান্ত’ রচনাটির গুরুত্ব সকলের মনোযোগের দাবি রাখে।
বইয়ের নামঃ গাভী বিত্তান্ত
লেখকঃ আহমদ ছফা
প্রকাশকঃ মাওলা ব্রাদার্স
পৃষ্ঠাঃ 129