September 28, 2023
Book Review

তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা: নির্মম ইতিহাস

তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা

1975 সালে 15ই অগাস্ট, 3রা নভেম্বর, এবং 7ই নভেম্বর – মাত্র চারমাসে এই তিনটি সেনা অভ্যুত্থান যুগান্তকারী, শতাব্দীর অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা, যেগুলোর মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিমন্ডলে ঘটে ব্যপক উত্থান-পতন। এমন কি সরকার পরিবর্তনের মত অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটে যায়।

1972 সাল। স্বাধীন বাংলাদেশ। ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে জেগে উঠা একটি দেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে বের হয়ে ফিরে হাল ধরেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের। ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হলো। উৎফুল্ল জনতা। তিনিই সকল চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর কঠিন যাত্রা।

স্বাধীন দেশে শুরু হলো চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। ভারতীয় বাহিনী, মুক্তিবাহিনী, মুজিব বাহিনী, সেনাবাহিনী, গেরিলাবাহিনী, গেদু মিয়া, কদম আলীরা সবাই বলে বিজয় আমরা ছিনিয়ে এনেছি। এবার আমার প্রাপ্য আমাকে দাও। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা। চাওয়ার লোক বেশি, দেয়ার লোক নাই। 1972 – 15 আগস্ট, 1975 অসহায়, দিশেহারা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব একূল ওকূল দু’কুল রক্ষার্থে হিমশীম খাচ্ছেন। গড়ে তুলেন বাকশাল ও রক্ষীবাহিনী।

‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা‘ রিভিউঃ

এই বইয়ের লেখক লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম.এ হামিদ পি.এস.সি সৌভাগ্যবশতঃ তিনটি ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানই অতি নিকট থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। প্রতিটি ঘটনার সাথে তিনি কম/বেশি প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সংযুক্ত ছিলেন। অন্যরা যেখানে শুনে শুনে না দেখে রঙ চঙ দিয়ে বিভিন্নভোবে অতিরঞ্জিত করে গল্পাকারে অলংকরণ করে লিখেছেন এবং তথ্য প্রকৃত বিকৃত করেছেন। লেখক এম.এ হামিদ স্টেশন কমান্ডার থাকার কারনে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সকল সদস্যদের লাশ উদ্ধার করে দাফনের ব্যবস্থা করেন। 75 এর রক্তাক্ত অধ্যায়ের সকল কুশীলব সম্পর্কে তিনি তার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ লিখেছেন।

তিনটি সেনা অভ্যুত্থান – হয়তো সবার জানা। যেটা জানেন না তা হচ্ছে ‘কিছু না বলা কথা’ হ্যাঁ এর জন্যই এই বইটি আপনাকে পড়তে হবে। নির্মোহ বিশ্লেষনে এবং সহজবোধ্য লেখনীর এই বইটি পড়তে বসলে, পড়া শেষ না করে উঠতে পারা যায় না। অত্যন্ত রোমাঞ্চকর যেকোন থ্রিলার উপন্যাসের চেয়েও অনেক বেশি টানটান উত্তেজানপূর্ণ রোমহর্ষক বর্ণনা এবং ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো এক নির্মম ইতিহাস। একের পর এক সেনাবাহিনী অপারেশন, ক্যু এবং কাউন্টার ক্যু, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, সশস্ত্র ইউনিট, জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, কর্নেল, মেজর, সেপাই’দের তৎপড়তা, জাসদের বিপ্লব, রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা ও চালচিত্র চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠবে। 1993 সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। বইটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। জাতীয় সংসদে বিতর্ক এবং মুজিব হত্যা মামলায় বইটি রেফারেন্স হিসেবে আলোচনায় এসেছে।

15 আগস্ট রাতে কি কি ঘটেছিল, কারা ছিল নেপথ্যে, কাদের মৌন সম্মতি আর কাদের তৎপড়তায় ঘটেছে এই অভ্যুত্থান! সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমান, কর্নেল শাফায়াত জামিল, খন্দকার মোশতাকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের ভূমিকা কেমন ছিল তার আলোচনা হয়েছে এই তিনটি সেনা অভ্যুত্থান বইতে।

‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা‘ বই থেকে তুলে ধরা হলো কিছু চৌম্বক অংশঃ

15ই আগস্ট, 1975
আগস্ট অভ্যুত্থানের প্রধান নায়ক মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ। তারা সম্পর্কে ছিল একে অপরের ভায়রা ভাই। মেজর রশিদ সতর্ক কথাবার্তা চালিয়ে মেজর ডালিম, নূর, হুদা, রাশেদ, পাশা, শাহরিয়ার এদেরকে দলে এনেছে। এরা সবাই ব্যক্তিগত কারণে শেখ সাহেবের উপর ক্ষীপ্ত ছিল।

অপারেশন পরবর্তী কার্য্যক্রমের যাবতীয় প্ল্যান প্রোগ্রাম ছিল মেজর রশিদের। রশিদ ছিল ধীর স্থির, নিখুঁত। টার্গেট দখল, নূতন রাষ্ট্রপ্রধানকে ধরে আনা, সশস্ত্র বাহিনী প্রধানদের একত্রকরণ এবং রাজনৈতিক বিষয়াদী হ্যান্ডেল করা। অত্যন্ত নিপুণতার সাথে আওয়ামীলীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ এর সাথে 2রা আগষ্ট, 1975 সতর্ক কথাবার্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাকে প্রস্তুত করা হয়।

– তোরা কী চাস, তোরা কী করতে চাস? – আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
-কী! তোদের এত সাহস! পাকিস্তান আর্মি আমাকে মারতে পারেনি। আমি জাতির পিতা। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে। কেউ আমাকে মারতে পারে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

অতঃপর আচমকাই ঝড়! ভোর সোয়া 5টায় আক্রান্ত হয়েছে ধানমন্ডি এলাকায় বিভিন্ন টার্গেট পয়েন্ট। 32নং রোডের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডে বাড়ির উপরের তলায় নিহত হন বেগম মুজিবসহ 5জন। সিঁড়িতে রাষ্ট্রপতি মুজিব, নিচ তলায় শেখ নাসের, শেখ কামাল, কর্নেল জামিল ও জনৈক পুলিশ ইন্সপেক্টর। মেজর ডালিম ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এর নেতৃত্বে শেখ মনি ও সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমন চালায়। এদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করার পিছনে মেজর নূর ও মেজর হুদা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং মোসলেম উদ্দিনও।

তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা রিভিউ
বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহ

15 আগস্ট অভ্যুত্থান ছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী অভ্যুত্থান। পাক-ভারতের ইতিহাসে এ ধরনের সেনা-অভ্যূত্থান এই প্রথম। মাত্র গুটিকয় জুনিয়র অফিসার ও মাত্র দুটি ইউনিটের অভিযানে এমন একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী অভ্যুত্থান ঘটলো, যা কিনা একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের পতন ঘটিয়ে দিলো।

3 নভেম্বর, 1975 (খালেদ মোশাররফ এর উত্থান পতন)
খন্দকার মোশতাক আহমদের শাসন আলম বেশিদিন স্থায়ী হলো না। মাত্র দুইমাস 18 দিন পর সংঘটিত হলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেনা অভ্যুত্থান। ঘটলো ক্ষমতার হাতবদল। 3 নভেম্বর, 1975 – এর মধ্যরাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশররফ এর নেতৃত্বে সংঘটিত হলো এই রক্তপাতহীন নীরব অভ্যুত্থান। একটি বুলেটও ফায়ার হলো না, একটি প্রাণীও মারা পড়লোনা। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সৈনিক ব্যারাকে সবাই ছিল ঘুমিয়ে। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে সবাই শুনলো গভীর রাতে অভ্যুত্থান ঘটে গেছে। ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। সেনা বাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমান বন্দী। সি.জি.এস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশররফ নতুন সেনা নায়ক। কর্ণেল শাফায়াত জামিলের 46 ইনফেন্ট্রি-ব্রিগেডের পরিচালনায় ঘটেছে এই অভ্যূত্থান।

কুখ্যাত জেল হত্যা
2/3 নভেম্বর গভীর রাতে সবার অজ্ঞাতে সংঘটিত হলো এক জঘন্যতম হত্যাকান্ড। রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি সৈন্যদল গাড়ি করে সেন্ট্রাল জেলে পৌঁছায়। তারা ভিতরে ঢুকে অন্তরীণ আওয়ামী-লীগ নেতাদের হত্যা করতে চায়। ঘাতক দলের সাথে জেলারের বাক-বিতন্ড হয়। পাগলা ঘন্টা বেঁজে ওঠে। জেল গেট থেকে আইজি (প্রিজন) সরাসরি বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মোশতাককে জেল গেটে মোসলেম উদ্দিনের আগম ও ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা বলেন। মোশতাক জলদ গম্ভীর কণ্ঠে তাদের জেলে ঢুকার নির্দেশ দেন। হতবাক আই.জি। খোদ প্রেসিডেন্ট বেআইনি নির্দেশ দিলে বেচারা আই.জি/ডিআইজি কি বা করতে পারে।

তাজউদ্দিন এবং নজরুল ইসলাম 1নং সেলে ছিলেন। পরবর্তী সেলে ছিলেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। তাদেরকে তাজউদ্দিনের সেলে এনে জড়ো করা হয়। ঘাতক মোসলেম উদ্দিন খুব কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে তাদের উপর গুলিবর্ষন করে। তাদের মধ্যে তিনজন সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান। তাজউদ্দিনের পাঁয়ে ও হাঁটুতে গুলি লাগে, প্রচন্ড রক্তক্ষরণে ধীরে ধীরে মারা যান। কেউ কিছু ভাল করে বুঝে উঠবার আগেই আকস্মিকভাবে ঘটে গেল এই হত্যাকান্ড।

ধারণা করা খন্দকার মোশতাকের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধী ছিলেন ঐসব রাজনৈতিক নেতা। কোন কারনে যদি তার বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যূত্থান ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, তার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে তার প্রতিপক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নির্মূল করে দেওয়ার পূর্ব প্ল্যান মত হত্যাকান্ড কার্যকর করে।

দেয়াল উপন্যাস রিভিউ: জীবন সৌন্দর্য আর সত্যের সন্ধান

7নভেম্বর, 1975 (ঐতিহাসিক সেপাই বিদ্রোহ)
7 নভেম্বর,1975 সাল। রাত 12টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সংঘটিত হলো ঐতিহাসিক সেপাই বিদ্রোহ। স্থান ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। প্রচণ্ড গোলাগুলি, চিৎকার আর হট্টগোলের মধ্যে দিয়ে উন্মোচিত হলো শতাব্দির এক ঐতিহাসিক মুহুর্ত। 1975 সালের সেপাই বিদ্রোহেও সেপাইরা খুব বেশি একটা লাভবান হয়নি, তবে তারা একচ্ছত্র ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। ঐতিহাসিক বিপ্লবের মধ্য দিয়েই তার উত্থান। সেপাই বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য ছিল-
ক) খালেদ-শাফায়াত অক্ষ-শক্তির উৎখাত।
খ) জিয়াউর রহমানের মুক্তি ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
গ) বিপ্লবী সৈনিকদের 12 দফার ভিত্তিতে শ্রেণীহীন সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা।

অভ্যুত্থানের প্রথম দু’টি লক্ষ্য সহজে অর্জিত হয়। তৃতীয় লক্ষ্য অর্জন বিপ্লব ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে বিপ্লবের প্রধান নেতা লেঃ কর্নেল তাহের বৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকার উৎখাতের অভিযোগে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন।

লেখকঃ
লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম.এ হামিদ পি.এস.সি 1932 সালে সিলেট জেলায় জন্মগ্রহন করেন। তিনি 1953 সালে কাকুল মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। 1955 সালে অ্যাকাডেমি থেকে কমিশন লাভ করে তৎকালিন 14 পাঞ্জাব রেজিমেন্টে সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে যোগদান করেন। পরবর্তী কালে 1963 সালে তিনি 3য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। তিনি চাকুরি জীবনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। 1971 সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি পেশোয়ারে পাকিস্তানী ক্যাম্পে অন্তরীণ হন। 1972 সালে তিনি সপরিবারে পলায়ন করে ঐ বছরই সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা পৌছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মিলিটারি সেক্রেটারী হিসাবে যোগদান করেন।

রকমারী থেকে বইটি কিনতে পারবেন

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
দ্বিতীয় খুনের কাহিনি - গোয়েন্দা গল্পকেও হার মানায়

[…] তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথ… […]

বাংলাদেশ রক্তের ঋণ: সত্য কল্পকাহিনি থেকে অদ্ভুত

[…] তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথ… […]

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর

[…] লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম. এ হামিদ রচিত ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথ…’ বইয়ে কর্নেল শাফায়াত জামিলকে […]

3
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x