ফিকশন বা কল্পকাহিনী ভিত্তিক বইয়ের চেয়ে কিছু কিছু নন-ফিকশন বই কল্পকাহিনী থেকেও অদ্ভুত।
যে সাহিত্যের উপাদানগুলো বাস্তব থেকে নেয়া এবং বাস্তবের সাথে সর্বত মিলে যায়, তাকে নন-ফিকশন সাহিত্য বলে।
জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে নন-ফিকশন বই বেশি পড়তে হবে। এখানে আমরা এমন কিছু নন-ফিকশন বইয়ের আলোচনা করবো যা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ 1971-1981 পর্যন্ত সময়কালের পটভূমিকে অবলম্বন করে অতি নিকট থেকে দেখা 5জন লেখকের 5টি নন-ফিকশন বই উল্লেখ করা হলো।
এখানে বাংলাদেশের 5টি বিখ্যাত নন-ফিকশন বই উল্লেখ করা হলোঃ
1. বাংলাদেশ রক্তের ঋণ, লেখক: অ্যান্থনি মাসকারেনহাস
বাংলাদেশ রক্তের ঋন বইটিতে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থানের ঘটনাবলি রয়েছে। বইটি বাংলাদেশের রাজনীতির দুই উচ্চপদস্থ ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমানকে কেন্দ্র করে। তারা জনপ্রিয়ভাবে আধুনিক বাংলাদেশের দুই প্রধান স্থপতি হিসেবে পরিচিত এবং প্রত্যেকের শাসনের অবসান হয়েছিল হত্যার মাধ্যমে।

বাংলাদেশ রক্তের ঋন বইটি বাংলাদেশের প্রথম দিকের নেতাদের সময়ের অবর্ণনীয় গল্প, মূলত বাংলাদেশের প্রথম 10 বছরের দুঃখজনক ইতিহাস। 1971 পরবর্তী থেকে 1981 জিয়াউর রহমান পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। বইটি লেখার আগে লেখক পুরুষ ও মহিলাদের সাথে 120 টিরও বেশি পৃথক সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। অফিসিয়াল আর্কাইভ এবং নথি পরিদর্শনের বিশেষাধিকার লেখকের ছিল।
2. তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লেখক লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম.এ হামিদ পি.এস.সি
1975 সালে 15ই অগাস্ট, 3রা নভেম্বর, এবং 7ই নভেম্বর – মাত্র চারমাসে এই তিনটি সেনা অভ্যুত্থান যুগান্তকারী, শতাব্দীর অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা, যেগুলোর মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিমন্ডলে ঘটে ব্যপক উত্থান-পতন। এমন কি সরকার পরিবর্তনের মত অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটে যায়।
15 আগস্ট রাতে কি কি ঘটেছিল, কারা ছিল নেপথ্যে, কাদের মৌন সম্মতি আর কাদের তৎপড়তায় ঘটেছে এই অভ্যুত্থান! সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমান, কর্নেল শাফায়াত জামিল, খন্দকার মোশতাকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের ভূমিকা কেমন ছিল তার আলোচনা হয়েছে এই তিনটি সেনা অভ্যুত্থান বইতে।
3. বঙ্গভবনে মোশতাকের ৮১ দিন, লেখক: আবু আল সাঈদ
১৯৭৫ সালে সাংবাদিক আবু আল সাঈদ দৈনিক সংবাদের সিনিয়র রিপোর্টার হিসাবে কর্মরত ছিলেন । ১৫ আগস্টের পর তার বঙ্গভবনে তার ‘ডিউটি’ থাকায় খুব কাছ থেকে দেখেছেন মোশতাকের শাসনকালকে । মোশতাকের ৮১ দিনের শাসন নিয়েই এই নন-ফিকশন বই’টি ।
খন্দকার মোশতাক 15 অগাস্ট প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। লেখক 15 অগাস্ট দিন থেকেই লেখা শুরু করেছেন। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা নয়। হত্যাকান্ডের পরবর্তী সময়কালই মুখ্য।

বঙ্গবন্ধুর নিষ্প্রাণ জমাটবাঁধা রক্তাক্ত লাশ 32 নম্বর সড়কের তাঁর বাড়ির সিঁড়িতে রেখেই খন্দকার মোশতাক অত্যন্ত নিপুণ হাতে মাত্র 14 ঘন্টার মধ্যে যেন গুছিয়ে ফেললেন পুরো দেশটাকে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস যারা জানতে আগ্রহী, সেসব পাঠকদের ‘বঙ্গভবনে মোশতাকের 81 দিন’ বইটি পড়তেই হবে। সাংবাদিক আবু আল সাঈদের এই বইটিতে নানা অজানা এবং চাঞ্চল্যকর তথ্য উপস্থাপন করেছেন।
4. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, লেখক: কর্নেল শাফায়াত জামিল, (অব:)
লেখক বইটির প্রথম অধ্যায়ে একাত্তরে তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত ও সম্মুখ যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন। সাথে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম.জি ওসমানি সাহেবের কথা এবং ভারতের গুর্খা রেজিমেন্টের আমাদের মাতৃভুমির জন্য আত্মত্যাগ ইত্যাদি।
লেখক বইটির 2য় ও 3য় অধ্যায়ে 15অগাষ্টে নির্মম নিষ্ঠুর হত্যালীলার বিবরণ, যে-ঘটনাধারা অত্যন্ত কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি এবং পরবর্তী 3রা ও 7ই নভেম্বর পর্যন্ত ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করেছেন।

তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা বইয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে শাফায়েত জামিল 15আগস্ট, 1975 এ ক্যুর বিষয়ে অবগত ছিলেন এবং যথেষ্ট সময় এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও খুনী ফারুক গংদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। বইটি পড়ে আমার মনে হল তিনি ‘৭৫ এ নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতেই বইটা লিখেছেন। সব মিলিয়ে বইটি সুপাঠ্য, বাংলাদেশের কালো রাজনীতির বিপুলা রহস্যের কিছুটা হয়ত অনাবৃত করতে পারে নন-ফিকশন বইটি।
5. দ্বিতীয় খুনের কাহিনি, লেখক মশিউল আলম
30 মে, 1981, ভোররাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নৃশংস হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডটি চট্টগ্রাম সেনানিবাসের কয়েকজন কর্মকর্তা ঘটিয়েছেন।
দুটি হত্যাকান্ড নিয়ে লেখক মশিউল আলম “ দ্বিতীয় খুনের কাহিনি ” উপন্যাসটি রচনা করেন ।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীন অন্যতম দুই চৌকশ মুক্তিযোদ্ধা সেনা কমান্ডার জেনারেল জিয়া এবং মনজুর । জেনারেল জিয়া হত্যাকান্ডের ঠিক দু’দিন বাদে অর্থাৎ 1 জুন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফায়ারিং রেঞ্জে খুন হন জিওসি জেনারেল আবুল মনজুর (বীর উত্তম)।
“দ্বিতীয় খুনের কাহিনি” মূলত একটি ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস। লেখক যেহেতু উপন্যাস লিখেছেন, তাই আছে কিছু তথ্যের ও সংলাপের অসংলগ্নতা। সচেতন পাঠকবৃন্দ বইটি কখনো সত্য ইতিহাস এবং কখনো উপন্যাস হিসেবে পড়লে এর কাহিনি গোয়েন্দা গল্পের চেয়েও অধিক উত্তেজক হবে।
বইগুলো রকমারিতে পাওয়া যাবে