বঙ্গভবনে মোশতাকের ৮১ দিন, লিখেছেন দৈনিক সংবাদের সিনিয়র রিপোর্টার আবু আল সাঈদ।
১৯৭৫ সালে সাংবাদিক আবু আল সাঈদ দৈনিক সংবাদের সিনিয়র রিপোর্টার হিসাবে কর্মরত ছিলেন । ১৫ আগস্টের পর তার বঙ্গভবনে তার ‘ডিউটি’ থাকায় খুব কাছ থেকে দেখেছেন মোশতাকের শাসনকালকে । মোশতাকের ৮১ দিনের শাসন নিয়েই এই বই ।
বঙ্গভবনে মোশতাকের ৮১ দিন বই রিভিউ
খন্দকার মোশতাক 15 অগাস্ট প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। লেখক 15 অগাস্ট দিন থেকেই লেখা শুরু করেছেন। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা নয়। হত্যাকান্ডের পরবর্তী সময়কালই মুখ্য।
বাংলাদেশ রক্তের ঋণ: সত্য কল্পকাহিনি থেকে অদ্ভুত
মোশতাক সরকারের প্রথম কাজ ছিল বাংলাদেশ বেতারের পরিবর্তে রেডিও বাংলাদেশ করা। রেডিও বাংলাদেশে বার বার প্রচার করা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট মোশতাক বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ আদায় করেছেন। একই সাথে ঘোষণা করা হচ্ছে নবনিযুক্ত প্রেসিডন্টে খন্দকার মোশতাক সন্ধ্যার পর জাতির উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন।
‘সারাদেশে কারফিউ ঘোষণা করা হলেও মানুষজন রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছিল, মিলিটারী গাড়িগুলো টহল দিচ্ছিল। বঙ্গবভনের সামনে ট্যাংক জড়ো করা হয়েছে। বিহারীরা অলিতে-গলিতে বাজি ফোটাচ্ছে। কোথাও কোথাও ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি। দুপুরের মধ্যে স্বাধীনতা বিরোধী লোকজন পথে নেমে এসেছিল।’
সারাদিন নানা ধরনের গুজব ছিল সকলের মুখে মুখে। কেউ বলছিল শেখ মুজিব পালিয়েছে, কেউ আবার বলছিল শেখ কামাল বেঁচে আছে। শেখ মনি পালিয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছিল। ভারত যেকোন সময় আমাদের আক্রমণ করতে পারে। আমাদের ‘তৌহিদী জনতা ও মিলিটারী প্রস্তুত ইত্যাদি আরো অনেক খবর এবং গুজব। কোথাও আওয়ামীল সমর্থক নেই। যেন পাকিস্তান কায়েম হয়ে গেছে।
সন্ধায় মোশতাক প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহন করেন। তার সাথে ভাইস প্রেসিডেন্ট, দশ জন মন্ত্রী ও ছয় জন প্রতিমন্ত্রী শপথ গ্রহন করেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিন বাহিনী প্রধান যথাক্রমে সেনাবাহিনী প্রধান কে. এম শফিউল্লাহ, নৌবাহিনী প্রধান কমোডর মোশাররফ হোসেন খান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ. কে. খন্দকার উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ক্যু উদ্যাক্তরা তো ছিলই।
তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা: নির্মম ইতিহাস
বঙ্গভবনে মোশতাকের ৮১ দিন
মোশতাক নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের নিয়ে প্রথমবারের মত একটি সংক্ষিপ্ত বৈঠকে মিলিত হন। চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে মন্ত্রীদের প্রথম যে খোশ খবরটা শোনান তা হলো, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ভুট্টো মুসলিম দেশগুলোর প্রতি খন্দকার মোশতাক সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতিদানের আবেদন জানিয়েছে। মোশতাক জানালেন অবিলম্বে চীন ও সৌদি আরবের স্বীকৃতি তিনি আদায় করবেন।
বঙ্গবন্ধুর নিষ্প্রাণ জমাটবাঁধা রক্তাক্ত লাশ 32 নম্বর সড়কের তাঁর বাড়ির সিঁড়িতে রেখেই খন্দকার মোশতাক অত্যন্ত নিপুণ হাতে মাত্র 14 ঘন্টার মধ্যে যেন গুছিয়ে ফেললেন পুরো দেশটাকে।
সন্ধ্যার পর খন্দকার মোশতাক জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন পেয়ারা পাকিন্তান রীতিতে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে বক্তব্য শেষ করার আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘সত্যিকার বীরের মতো অকুতোভয় চিত্তে’ এগিয়ে আসার জন্য তাদের মোবারকবাদ জানাতে ভুললেন না। ‘খন্দকার মোশতাকের ভাষণের কিছু অংশ তুলে দেয়া হলোঃ
‘বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম। আসসালামু অলাইকুম। প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা। এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঠিক ও সত্যিকারের আকাঙ্খাকে বাস্তবে রূপদানের পূতপবিত্র দায়িত্ব সামগ্রিক ও সমষ্ঠিগতভাবে সম্প্রদায়ের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা ও বাংলাদেশের গণমানুষের দোয়ার উপর ভরসা করে রাষ্টপতি হিসাবে দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে। বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বজ্রকঠিন দায়িত্ব সম্পাদানের পথ সুগম করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সত্যিকারের বীরের মতো অকুতোভয় চিত্তে এগিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, নৌ বাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য ও আস্থা প্রকাশ করেছেন। এরা সবাই একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন।…..” বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’।।
মাওলানা ভাসানী খন্দকার মোশতাকের দায়িত্ব গ্রহণকে ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেছেন তাঁর পাঠানো টেলিগ্রামে। টেলিগ্রামে ভাসানী আরো লিখেন, দেশ থেকে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি তোমাকে (মোশতাক) দূর করতে হবে। নতুন সরকার ও তোমার (মোশতাক) ওপর আল্লাহতায়ালার রহমত বর্ষিত হোক।
বঙ্গভবনের আছেন এম. এ. জি ওসমানী তিনি ‘ক্যান্টনমেন্টের জেনারেল ও বঙ্গভবনে অবস্থানরত মেজর কর্নেলবৃন্দের যারা ক্যু’য়ের নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের মধ্যে সেতুর কাজ করছেন ‘।
তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া)র দুই পত্র ব্যারিস্টার মইনুল এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই দুইভ্রাতা এবং তাদের প্রতিষ্ঠান ইত্তেফাকের তৎকালীন অবস্থান না লিখলে হয়তো পুরো ইতিহাসকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণে পাঠক সুযোগ পেতেন না। সাংবাদিক আবু আল সাঈদের জবানিতে অনেকবার ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষের মোশতাকপন্থি চরিত্রের কথা এসেছে। ব্যারিস্টার মইনুল বাকশাল থেকে পদত্যাগ করে সেই সময় প্রশংসিত হয়েছিলেন বিভিন্ন মহল থেকে। অথচ, ‘ তাঁকেও কয়েকদিন বঙ্গভবনে আসতে যেতে দেখা গেছে। ‘
বঙ্গভবন তখন সরগরম। শেখ সাহেবের মন্ত্রিসভার প্রায় সকলেই অলংকৃত করছেন মোশতাকের মন্ত্রিসভা। তাজউদ্দীন আগেই বাদ পড়েছিলেন মন্ত্রিসভা থেকে। মনসুর আলী, কামারুজ্জামান এবং সৈয়দ নজরুলকে বাগে আনা গেল না৷ পাঠিয়ে দেওয়া হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
‘ইতিমধ্যে ঢাকা শহরটা আবার সচল হয়ে উঠেছে। চাল ব্যবসায়ী সমিতি থেকে শুরু করে রিকশা মহাজন, মৎসজীবী সমবায় সমিতি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি কোনটাই বাদ নেই যারা মোশতাকের সরকারকে সমর্থন জানিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছেন। ‘
পরিচালক,অভিনেতা কেউ পিছিয়ে নেই অভিনন্দিত করতে। যেমন:
‘ খান আতাউর রহমান একটা নয়া গান লিখে সুর করে সমবেত কন্ঠে রেডিও টেলিভিশনে প্রচার করছেন। ১৯৬৫-এর যুদ্ধের সময়কার কিছু দেশাত্মবোধক গান পুনঃপ্রচারিত হচ্ছিল। এসব করার জন্য একদল লোক আগে থেকেই স্ব স্ব স্থানে বসেছিল এমনটাই মনে হতো। ‘
ভারতের বিশেষ তৎপরতা দেখা যায়নি। সোভিয়েট ইউনিয়নের চার্জ দ্য এফেয়ার্স এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতি ছিল নয়া মন্ত্রিসভার দপ্তর বন্টন অনুষ্ঠানে। চীন, ইরানসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের স্বীকৃতি মিলতে লাগল৷ পাকিস্তানের সাথে দোস্তি ঝালাই করে নেওয়ার কথা সমস্বরে শোনা যাচ্ছিল৷ পাকিস্তানের হাইকমিশন স্থাপনের জন্য মতিঝিলে জায়গা প্রায় ঠিকঠাক। ভুট্টো বাংলাদেশের নয়া সরকারের সাথে দোস্তির নজরানা পাঠালেন ১০ হাজার টন চাল এবং কাপড়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মার্কিনমুলুকে গেছেন নিক্সনকে বশে আনতে। সেখান গিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদের সাথে সাক্ষাৎ করে দোজাহানের অশেষ নেকি হাসিল করলেন৷ অর্থমন্ত্রী জনাব এ আর মল্লিক বিদেশ সফর থেকে বেশি বেশি ভিক্ষার আশ্বাস পেয়ে ফিরলেন। খুশিয়াল গলায় সাংবাদিকদের ব্রিফ করলেন।
আওয়ামী লীগের এককালীন সভাপতি মওলানা তর্কবাগীশ অসুস্থ শরীর নিয়েও মোশতাকের জন্য দোয়া না করে পারলেন না। হাজী দানেশ, মওলানা মতিনরাও এগিয়ে এলেন মোশতাকের কল্যাণের লক্ষ্যে।
এদিকে সেনাবাহিনীতে মেজরগং বনাম সিনিয়র কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব বাড়ছিল। এই বিভেদের কথা খুব বেশি বিস্তারিত আনতে পারেননি লেখক। বরং বঙ্গভবন এবং ক্যান্টনমেন্টের বাইরে সারাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থির চিত্র অনেকটা স্বচ্ছভাবে আনতে পেরেছেন৷
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস যারা জানতে আগ্রহী, সেসব পাঠকদের ‘বঙ্গভবনে মোশতাকের 81 দিন’ বইটি পড়তেই হবে। সাংবাদিক আবু আল সাঈদের এই বইটিতে নানা অজানা এবং চাঞ্চল্যকর উপস্থাপন করেছেন।