মধ্যাহ্ন উপন্যাসটি 1905 থেকে 1947 পর্যন্ত ঐতিহাসিক পটভূমিকে অবলম্বন করে কাহিনীবহুল ও চরিত্রবহুলের আখ্যান।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদ রচিত উপন্যাস “মধ্যাহ্ন” 2006 এ প্রথম খণ্ড এবং 2007 এ দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। হুমায়ুন আহমেদ তার জন্মপূর্ববর্তী গ্রামীণ বাংলার বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের একটি কালখণ্ড পুননির্মাণ করেছেন।
মধ্যাহ্ন উপন্যাস রিভিউ
উপন্যাসটি রচনার জন্য বাংলাদেশের নেত্রকোণা এলাকা বেছেঁ নিয়েছেন লেখক। পঞ্চাশ বছর বয়স্ক প্রৌঢ় বৃদ্ধ হরিচরণ পুকুর ঘাটে বসে আছেন – এমন একটি দৃশ্য দিয়ে উপন্যাসটির সূচনা।
বান্ধবপুর নিবাসী সফল ও সৎ ব্যবসায়ী হরিচরণ সাহা মুসলমান একটি বালককে আদর করার দোষে সমাজচ্যুত হন এবং পরবর্তীতে ঋষিসুলভ জীবন বেছে নেন। এরপুর একে-একে যুক্ত হন এলাকার ব্রাহ্মণ অম্বিকা ভট্রাচার্য ঘটনাক্রমে মুসলমান হয়, যার নাম সিরাজুলম ইসলাম ঠাকুর; কাঠমিস্ত্রি সুলেমান; সুলেমানের রূপবতী স্ত্রী জুলেখা তালাকের পর আশ্রয় নেয় বেশ্যাপল্লীতে, শেষাবধি কোলকাতায় গিয়ে সে চানবিবি নামে সুকণ্ঠি গায়িকা হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে; সুলেমানের রূপবান পুত্র জহির; সোনাদিয়ার জমিদার বাবু শশাংক পাল; অন্যতম সমাজপতি ন্যায়রত্ন রামনিধি চট্টোপাধ্যায়; শল্লার দশানির মুসলমান জমিদার নেয়ামত হোসেন এবং তার অর্থে নির্মিত জুম্মাঘরের ইমাম মাওলানা ইদ্রিস; সোনাগঞ্জ লঞ্চঘাটের টিকেটবাবু ধনু শেখ পরবর্তীতে লঞ্চের মালিক হন।
ধনু শেখ জমিদার এবং বিপ্লবী জীবনলালকে ধরিয়ে দিয়ে লাভ করে ব্রিটিশরাজের দেয়া খানসাহেব উপাধি; কলিকাতা প্রবাসী মণিশংকর দেওয়ান; স্বদেশী-করা যুবক শশী ভট্টাচার্য যার প্রকৃত নাম কিরণ গোস্বামী এবং তার সতীর্থ জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়; কবিরাজ সতীশ ভট্টাচার্যের কন্যা যমুনা যাকে ধর্ষণের কারণে সমাজপতিরা বেশ্যালয়ে আশ্রয় গ্রহণের বিধান দেন; অদূরবর্তী সোহাগগঞ্জ বাজারের রঙিলা নটিবাড়ির মালেকাইন সরযুবালা; মোহনগঞ্জের বরান্তর গ্রামের মসজিদের ইমাম এবং গায়ক আব্দুল হক যার ডাকনাম উকিল মুন্সী ও তার নিঃসন্তান স্ত্রী ‘লাবুসের মা’; মোহনগঞ্জের বাম গ্রামের বিদ্বান মানুষ শৈলজারঞ্জন মজুমদার এবং সর্বশেষে জোড়াসাঁকোর ব্রাহ্ম জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি গান লেখেন, গানে সুর দেন। অনুপস্থিত থেকেও ভূমিকা রেখেছে হরিচরণ সাহার কন্যা শিউলি— সে শৈশবে পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছিল।
মধ্যাহ্ন হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম প্রধান শিল্পকীর্তি। তার উপন্যাসগুলো সাধারণত ছোট মাপের হয়ে থাকে, বিপরীতে এটি একটি বড় মাপের উপন্যাস। ঐতিহাসিক না-হলেও এটি ইতিহাসাশ্রয়ী। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে গ্রাম বাংলার নগরায়ন, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, বিভিন্ন মানুষের চরিত্রের নানা দিক এই উপন্যাসে অঙ্কিত হয়েছে নানা আকর্ষণীয় ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে।
দেয়াল উপন্যাস রিভিউ: জীবন সৌন্দর্য আর সত্যের সন্ধান
মধ্যাহ্ন শুরু শেষ পর্যন্ত উপভোগ্য নানাকাহিনীর সমন্বিত অবয়ব। হরিচরণ সাহার ঋষি সুলভ চারিত্র্যের বিপরীতে জমিদার শশাঙ্ক পালের ভোগবাদিতা বা মাওলানা ইদরিসের নিষ্কলুষ ব্যক্তিমানসের বিপরীতে ধুরন্ধর ধনু শেখের নির্লজ্জতা ও শঠতার তুলনা অনেক প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে। তালাকের পর কাঠমিস্ত্রি সুলেমানের স্ত্রী জুলেখা বাপের বাড়ি না গিয়ে বারবনিতার জীবন বেছে নেয়। তার এই কঠিন অথচ অকাতর সিদ্ধান্ত মানবমনের জটিল ও রহস্যময় দিকের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে, পাঠককে ভাবিত করে।
বাস্তবতার সঙ্গে অসম্ভবের সন্ধি হুমায়ূন আহমদের প্রিয় কৌশল যা মধ্যাহ্ন উপন্যাসেও লেখক দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। নানা অলৌকিক ও আধিভৌতিক কাহিনীকণাকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রশ্রয় দিয়ে লেখক প্রমাণ করেছেন তিনি জাদু বাস্তবতার দক্ষ কারিগর। অন্যান্য অনেক রচনার মতো এ উপন্যাসেও অসম্ভবের বহুবর্ণ উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়।
বইটি রকমারীতে পাওয়া যাবে।