অসমাপ্ত আত্মজীবনী, লেখক রাজনীতির কবি শেখ মুজিব 1967 সালে জেলে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি।
শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা চারটি খাতা 2004 সালে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার হস্তগত হয়। খাতাগুলি অতি পুরানো, পাতাগুলি জীর্ণপ্রায় এবং লেখা প্রায়শ অস্পষ্ট। মূল্যবান সেই খাতাগুলি পাঠ করে জানা গেল এটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, যা তিনি 1967 সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। বইটির ফ্লপে এভাবেই বইটিকে পরিচিত করে দেয়া হয়েছে। লেখক যখন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তখন এর চেয়ে অধিক ভূমিকার আর কী প্রয়োজন থাকতে পারে!
বইয়ের একেবারে শুরুতে লেখক (বঙ্গবন্ধু) সরল স্বীকারোক্তি করেছেন ‘লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।”
রাজনীতির কবি শেখ মুজিব এর অসমাপ্ত আত্মজীবনী রিভিউ
শেখ মুজিবুর রহমান তিনি বাংলার বন্ধু তিনি বঙ্গবন্ধু, তিনি রাজনীতির মানুষ, লেখক নন। ভাষায় অলংকার আর রূপকের কারুকার্য তার লেখায় না থাকলেও বইটি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তে হয়। হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা সহজ বাক্য, সহজ শব্দ, সহজ ভাষা ঠিক তাঁর ভাষণগুলোর মতোই। বন্ধুবান্ধব আর স্ত্রীর অনুরোধে তিনি 1967 সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি।
লেখকের রাজনৈতিক জীবনের শুরু 18 বছর বয়সে (1938 সাল) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাদের স্কুল পরিদর্শনে আসেন তখন থেকে। তবে তিনি সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন 1941 সালে তার মেট্রিক পরীক্ষার পর থেকে। 43 এর দূর্ভিক্ষের সময় শেখ মুজিব পুরোপুরি মাঠ পর্যায়ের কর্মী হিসাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এখানে টুঙ্গীপাড়ার ডানপিটে সাহসী সমাজ সচেতন কিশোর শেখ মুজিবের পরিণত বলিষ্ঠ নেতা হয়ে ওঠার কিছুটা আভাস পাই এবং তাঁর চেতনা, উপলব্ধি, রাজনৈতিক দর্শন আর তার স্বপ্নের সাথে এবং তার বোধের সাথে পরিচিত হয়ে উঠি।
শেখ মুজিব রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেছেন মূলত মানুষের জন্য সমগ্র বইটি থেকে এইটুকু অন্তত বুঝতে পারা যায়। তিনি গোপন রাজনীতি, পালিয়ে থেকে বিবৃতি দেয়ার রাজনীতি পছন্দ করতেন না। গ্রেফতারের পরোয়া করতেন না। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে সমগ্র জীবনে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। একেবারে শুরু থেকেই অধিকাংশ সময় জেলের ভিতর কাটিয়েছেন তিনি। তিনি কাজ করতে করতে শিখেছেন, ভুল হলে স্বীকার করেছেন, সংশোধনের চেষ্টা করছেন। বলেছেন এভাবে, ”আমার যদি কোনো ভুল হয় বা অন্যায় করে ফেলি, তা স্বীকার করতে আমার কোনোদিন কষ্ট হয় নাই।
পুরো বইটিতে সবচেয়ে বেশি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এর কথা এসেছে। পুরো বইয়ে লেখক তাকে শহীদ সাহেব বলে সম্বোধন করেছেন। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন লেখকের রাজনীতিতে আসার প্রেরণা, রাজনৈতিক পরামর্শদাতা এবং পরম শ্রদ্ধার পাত্র। এই বইয়ে লেখকের মাধ্যমে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বেশ কিছু জানা যাবে। লেখক একেবারে শুরুর দিকেই বলছেন, ”ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে লেখকের উক্তিঃ
শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, নীচতা ছিলনা, দল মত দেখতেন না, কোটারি করতে জানতেন না, গ্রুপ করারও চেষ্টা করতেন না। উপযুক্ত হলেই তাকে পছন্দ করতেন এবং বিশ্বাস করতেন। কারণ, তার আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। তার সাধুতা,নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন। এ জন্য তাকে বারবার অপমানিত ও পরাজয়বরণ করতে হয়েছে। উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয়।

লেখক বইয়ে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের কথা বলেছেন। সমগ্র বইয়ে লেখক তাকে হক সাহেব বলে সম্বোধন করেছেন। তৎকালিন সময়ে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এর জনপ্রিয়তা কিরুপ ছিল সেটা বোঝাতে লেখকের হক সাহেবকে নিয়ে কিছু কথা বই থেকে তুলে ধরা হলো।
“একদিনের কথা মনে আছে; আব্বা ও আমি রাত দুইটা পর্যন্ত রাজনীতির আলোচনা করি। আব্বা আমার আলোচনা শুনে খুশি হলেন। শুধু বললেন, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত আক্রমন না করতে। একদিন আমার মা-ও আমাকে বলেছিলেন,“বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলিও না।” শেরে বাংলা মিছি মিছিই ‘শেরে বাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চাননা এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে মিলে মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন? এই সমস্ত আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার খুব ভক্ত, আমাদের বাড়িতে সকল সময়েই আসতেন, আমাদের বংশের সকলকে খুব শ্রদ্ধা করতেন- দাঁড়িয়ে বললেন,”যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব।” এ কথার পর আমি অন্যভাবে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। সোজাসুজিভাবে আর হক সাহেবকে দোষ দিতে চেষ্টা করলাম না। কেন পাকিস্তান আমাদের প্রতিষ্ঠা করতেই হবে তাই বুঝালাম। শুধু এইটুকু না, যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গিয়েছি, তখনই জনসাধারণ আমাদের মারপিট করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, মার খেয়ে।”
লেখক এই বইয়ে দেশভাগের আগে ও পরের কথা বলেছেন। উঠে এসেছে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার কথা, কখনও ঢাকায়, কখনও কোলকাতায়, কখনো এপারে, কখনো ওপারে। রাজনৈতিক নেতারা হিন্দু-মুসলিম অসন্তোষ উস্কে দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টিতে সহায়তা করেছেন, নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে। এখনকার মতোই ইমাম, হুজুর আর পীরসাহেবেরা অংশ নিয়েছেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুঘটক হিসেবে। জনগণকে ধর্মের নামে আলাদা করতে চেয়েছেন বারবার, সাম্প্রদায়িক নেতা আর অনেক ধর্মগুরু। এইসব ঘটনাই সম্ভবত ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান আন্দোলনের একজন নিবেদিত কর্মী রাজনীতির কবি শেখ মুজিব’কে বুঝতে শিখিয়েছে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ না গড়তে পারলে আসলে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না।
সেই সময়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাওলানা ভাসানী, যাঁকে বইয়ে বিভিন্ন জায়গায় লেখক মূলত মাওলানা সাহেব হিসেবে সম্মোধন করেছেন, তাঁর প্রতি বিভিন্ন জায়গায় ভরসা আর শ্রদ্ধার প্রকাশ থাকলেও তাঁর কিছু কর্মকাণ্ডে লেখকের বিরক্তিও চাপা থাকেনি। সম্ভবত ১৯৪৮ এ মাওলানা ভাসানী আসাম ছেড়ে বাংলায় চলে আসেন।
বাংলাদেশ রক্তের ঋণ: সত্য কল্পকাহিনি থেকে অদ্ভুত
ভাষা আন্দোলন নিয়ে সরাসরি লেখকের লেখনি থেকে তুলে দেয়া হলোঃ
“বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচি ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হল উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হল আমরা বুঝতে পারলাম না।
দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরষ্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়শিয়ার লোকেরা মালয় ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপুর্ণ কথা বলা চলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারে নাই।”
লেখক শেখ মুজিবুর রহমান খুব সুন্দর করে তার ভ্রমন কাহিনী লিখে গেছেন। পুরো বইয়ে তিন চারবার তার বিভিন্ন স্থানে ভ্রমনের বিবরন এসেছে। উনি খুব গুছিয়ে বেশ কিছু খুটিনাটি সহ ভ্রমন কাহিনী গুলো লিখেছেন।

চীন আর চীন ভ্রমন নিয়ে লেখার শেষ পর্যায়ে লেখকের সমাজতন্ত্রের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে। লেখক বলেন-
“আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধ পরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্ব শান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল , সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে- তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্বশান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।”
রাজনীতির বাইরে কবি-সাহিত্যিক-লেখক-সঙ্গীতজ্ঞদের প্রতি রাজনীতির কবি শেখ মুজিব এর প্রবল আগ্রহ আর সম্মান – তার প্রকাশ ঘটে বিভিন্ন জায়গায়। উনি পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে যেমন রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতা শুনিয়েছেন, তেমনি চীনে শান্তি সম্মেলনে বিখ্যাত লেখক আসিমভ আর তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের সাথে দেখা হওয়ার কথা গর্বভরে বলেন, আবার সমসাময়িক আব্বাসউদ্দিন-মুনীর চৌধুরীদেরও স্মরণ করেন গুরুত্বের সাথে।
বইটির পিডিএফ এখান থেকে ডাউনলোড করে পড়তে পারবেন
বইটা শেষ করতে হলো অতৃপ্তি নিয়ে। অতৃপ্তির কারণ আসলে নামেই বোঝা যায় – অসমাপ্ত আত্মজীবনী। কোনো পরিকল্পনা ছাড়া, কোনো উপসংহার ছাড়া, লেখকের অসমাপ্ত জীবনের মতোই একেবারেই হুট করে শেষ হয়ে গেল বইটা। গোপালগঞ্জের কিশোর শেখ মুজিব যখন একটু একটু করে গোটা বাংলাদেশের রাজনীতির কবি শেখ মুজিব হয়ে উঠছেন ঠিক তখনই শেষ হয়ে গেল বইটা।