শেষের কবিতা উপন্যাসের মুল দুটি চরিত্র অমিত এবং লাবন্য দুজন ভিন্ন দুই মেরুর মানুষকে এখানে মেলাচ্ছেন প্রেমের মাধ্যমে।
শেষের কবিতা রিভিউ / বিশ্লেষন
অমিতের বাপ ছিলেন দিগ্বিজয়ী ব্যারিস্টার। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এ’র কোঠায় পা দেবার পূর্বেই অমিত অক্সভোর্ডে ভর্তি হয়। সেখানে পরীক্ষা দিতে দিতে এবং না দিতে দিতে সাত বছর গেল কেটে। বুদ্ধি বেশি থাকাতে পড়াশুনো বেশি করে নি, অথচ বিদ্যেতে কমতি আছে বলে ঠাহর হয় না। অমিতের অর্থের কোন চিন্তা করতে হয় না। তিন পুরুষ খেয়ে যাওয়ার মত প্রচুর সম্পত্তি রয়েছে।
অমিত পাঁচজনের মধ্যে যেকোন একজন মাত্র নয়, ও হল একেবারে পঞ্চম। দাড়িগোফঁ-কামানো চাঁচা মাজা চিকন শ্যামবর্ণ পরিপুষ্ট মুখ, স্ফুর্তিভরা ভাব, চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল, নড়াচড়া চলাফেরা চঞ্চল, কথা বলায় পটু, একটু ঠুকলেই স্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়ে। যেটা কেউ পছন্দ করে না, তার সেটা পছন্দ। অথবা সবাই যা পছন্দ করছে, তা সে অপছন্দ করছে। কারন তার স্বতন্ত্রটা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। পাঞ্জাবি পরে বাঁ কাধ থেকে বোতাম ডান দিকের কোমর অবধি। এমন বেশ ভুশা সাজ পোশাকে চলত যেন সবার মনোযোগটা তার দিকে থাকে। যারা বেশ ভুশা সাজ পোশাকে আধুনিক মনে করে অমিত তাদেরকে ব্যঙ্গ করে। অমিত বলে, ফ্যাশনটা হলো মুখোশ, স্টাইলটা হলো মুখোশ্রী। অমিতের নেশাই স্টাইলে। কেবল সাহিত্য-বাছাই কাজে নয়, বেশে ভুষায় ব্যবহারে। ওর চেহারাতেই একটা বিশেষ ছাঁদ আছে। অমিত ফ্যাশনকে বিদ্রুপ করে। অমিত যেহেতু সুন্দর কথা বলে, তার চরিত্র সবার থেকে আলাদা স্বভাবতই মেয়েরা তার প্রতি আকর্ষনবোধ করে। অমিতের প্রতি যারা আকৃষ্ট হতো, তাদের প্রতি অমিত আকৃষ্টবোধ করে না। মেয়েদের সম্পর্কে তার আগ্রহ নেই। কিন্তু ঔৎসুক্য আছে। আত্মীয়স্বজন অমিতের বিয়ের আশা ছেড়েই দিয়েছে।
অমিতের মনস্তত্ব বা তার সম্পর্কে গভীর কোন আলোচনা শেষের কবিতা উপন্যাসে নাই। কিন্তু লাবন্য চরিত্র নিয়ে বিস্তর আছে।
লাবন্যের পিতা কলেজের একজন অধ্যক্ষ। মাতৃহীন মেয়েকে এমন করে মানুষ করেছেন যে, বহু পরীক্ষা-পাসের ঘষাঘষিতেও তার বিদ্যাবুদ্ধিতে লোকসান ঘটাতে পারে নি। লাবন্য’র পাঠানুরাগ রয়েছে প্রবল। জ্ঞানের চর্চায় তার মনটা নিরেট করেছিল। মজবুত পাকা মন–বাইরে থেকে আচঁড় লাগলেও যাতে দাগ না পড়ে। লাবন্য’র বাবা এতদূর পর্যন্ত ভেবে রেখেছিলেন যে, লাবণ্যের নাইবা হল বিয়ে, পাণ্ডিত্যের সঙ্গেই চিরদিন নয় গাঁঠবাঁধা হয়ে থাকলো। শোভনলাল নামের একজন ছাত্র ছিল লাবন্যর বাবার। পড়ার প্রতি খুব মনোযোগী, এরকম আর কাউকে দেখা যায় না। চোখের ভাবের স্বচ্ছতায়, চোঁটের ভাবের সৌজন্যে, হাসির ভাবের সরলতায়, মুখের ভাবের সৌকুমার্যে তার চেহারাটি দেখবামাত্র মনকে টানে। লোকচক্ষুর অগোচরে লাব্যন্যকে ভালবাসে সে।
শেষের কবিতায় লাবন্য একটি অনুপম চরিত্র। 1929 সালে দাড়িয়ে লাবন্য চরিত্রটির আধুনিকতাই তার প্রমাণ। লাবন্য তার 47 বৎসর বয়স্ক পিতাকে বিধবা এক মহিলার সাথে বিয়ে দেন। লাবন্য ব্যক্তি স্বাতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। কোন সামাজিক সংস্কার বা ট্যাবু তার নেই। সে স্বাধীন ও সাহসী, পিতার সম্পত্তি নিতে অস্বীকার করেছে। শেষমেশ বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়েছে শিলং এ যোগমায়ার বাড়িতে গৃহ শিক্ষত্রীর কাজ নিয়েছে। ইংরেজী সাহিত্য পড়ছে গ্রীক পড়ছে। শোভন লালের প্রেম তাকে টলাতে পারেনি। এই সময়ে এসে লাবন্যের মনে কোথাও একটা চঞ্চল হাওয়া প্রবেশ করছে। সেই হাওয়া প্রেমের একটা বীজ বপন করেছিল একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।
অমিত থাকত শিলং সেখানেই হলো দুজনের মুখোমুখী সংঘর্ষ। দুটি গাড়ি চলছিল দুটি ভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু পথ এক হওয়ায় তারা একে অপরের কাছাকাছি এসে পড়লো। শিলং পাহাড়ে অমিত এবং লাবন্য দুজন দুজনের প্রতি আকর্ষনবোধ করলো। এটা স্বাভাবিক কারন অমিত তার সমাজে এতদিন যত মেয়েদের দেখেছিল তাদের মধ্যে লাবন্যর মতো কারো প্রতি আকর্ষনবোধ করেনি আগে। অমিত চেয়েছিল এমন একজনকে যে হবে অদ্বিতীয়, নিজের পরিচয় হবে যার পরিচয়। অর্থাৎ ব্যক্তিত্বে এবং চরিত্রে তার একটি বলিষ্ঠতা থাকবে। লাবন্যকে সেভাবেই আবিস্কার করলো অমিত এবং তাকে তার ভাল লেগে গেল। লাবন্যর দিক থেকে অমিত যে প্রবনতার সাথে যে গতির সাথে লাবন্যর কাছে পৌছেছে, যেভাবে লাবন্যর সাথে কথাবার্তা শুরু করলো। লাবন্য এমন পুরুষকে আগে দেখেনি। শোভন লালকে সে দেখেছিল কিন্তু মাথা নিচু করে তার কাছে এসেছিল। শোভন লালের ভালবাসা ছিল কিন্তু সেই জোর ছিল না। অমিত সজোরে আঘাত করলো লাবন্যকে এবং অমিতের প্রতি মুগ্ধ হলো লাবন্য। তারা কাছাকাছি চলে এলো। কারন দুজনের মধ্যে একটি ফাক ছিল। এটা তাদের রুচি, তাদের মনন, তাদের মেধার। অমিত তার সমাজে কথা বলত ঠিক কিন্তু সে কখনোই তার রুচির তৃষ্ণা মেটাবার কোন দোসরকে খুজে পায়নি। তেমনভাবে লাবন্যও অনেকটা নির্বান্ধব ছিল, তার অনুভুতিগুলো শেয়ার করার মত কেউ তার ছিল না। যখন তারা কাছাকাছি এলো যখন দেখলো তাদের পছন্দ তাদের রুচি একে অপরের সাথে মিলে গেল তখন তারা একে অপরের প্রতি আরো মুগ্ধ হলো। প্রেম হলো। পরিনতি হলো অমিত এবং লাবন্য পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রেখে দুরত্ব পূর্বক দুজন দুজনার কাছ থেকে সরে আসে নিজেদের জীবনের জন্য সুখের প্রয়োজনে।
শেষের কবিতা উপন্যাসটি বাঙ্গালিদের কাছে একটি রোমান্টিক নষ্টালজিয়া। এই উপন্যাসটির মধ্যে হয়তো তেমন কিছুই নেই। একটি উপন্যাসের নিরিখে এই উপন্যাসটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গ্রন্থনা, প্লট নির্মান, চরিত্র চিত্রায়নে প্রচুর দুর্বলতা রয়েছে। প্রচুর সমালোচনা রয়েছে। তা স্বত্বেও শেষের কবিতা উপন্যাসটিকে অগ্রাহ্য করা যায় না। এই উপন্যাসটিতে যে রোমান্টিকতা রয়েছে, তা বাংলা উপন্যাসের নিরিখে অসামান্য এবং ব্যতিক্রমী। যা আমাদেরকে বুধ করে রাখে। বাংলা সাহিত্যে এরকম আধুনিক উপন্যাস খুব কমই লেখা হয়েছে। এই উপন্যাসের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ক্রিটিসাইজ করেছে। তার চরিত্র যোগমায়া ও লাবণ্য’কে পরম্পরা হিসাবে দেখলে তারা যতটা আধুনিক তা 1929 এর সাপেক্ষে আজকের দিনে দাড়িয়ে দেখলে খুব সহজলব্য ছিল না। যে সময় রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসটি লিখেছেন, সে সময় রবীন্দ্র বিরোধীতার একটা আবহ চলছে। রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসে খুব সুনিপুনভাবে রবীন্দ্র বিরোধীতার আবহটা নিয়ে এলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন তিনি এই সময় প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ যে চির নতুন এবং চির আধুনিক এই কথাটা শেষের কবিতা প্রমান করে দিয়েছে।