সক্রেটিস এর জন্ম 469 বা 470 খ্রিষ্টাব্দে গ্রীসের এথেন্সে। তার বাবার নাম সফ্রোনিস্কস্। তিনি ছিলেন এ্যালোপেকি গোষ্ঠীর লোক। এটি এথেন্সের দশটি প্রধান গোষ্ঠীর একটি।
হাসান আজিজুল হক এর ‘সক্রেটিস’ রিভিউ
সক্রেটিস যৌবনে ভারি অস্ত্রে সজ্জিত পদাতিক বাহিনীতে কাজ করতো। তার মায়ের নাম ফেনারিটি। তিনি ধাত্রী ছিলেন। তার পেশার তুলনা দিতে তিনি পছন্দ করতেন, বলতেন মা মানব-শিশু প্রসবে সহায়তা করতেন আর তিনি চিন্তা-ভাবনা প্রসবের বেলায় সহায়তা করতেন। তিনি খুব সাধারন বিবাহিত পারিবারিক জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিলো জানথিপি। তাদের তিন সন্তান ছিল। সত্তর বছর বয়সে সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড যখন কার্যকর হয়, তখন তাঁর বড়ো ছেলেটি বালকমাত্র, অন্য দুটি নিতান্তই শিশু। মনে হয় সক্রেটিস বেশি বয়সে বিয়ে করেছিলেন।
জীবন রক্ষার জন্য নূন্যতম দরকারটার কথা বাদ দিলে সক্রেটিসের মতো জাগতিক প্রয়োজন থেকে এমন সম্পূর্ণ মুক্ত মানুষ ইতিহাসে কমই দেখা যাবে। পোশাক পরতেন খুবই সাধারণ। পোশাকে ছিরিছাঁদ থাকতো না। খালি পায়ে থাকতেন বেশির ভাগ সময়। তাঁর কষ্টসহিষ্ণুতা ছিলো প্রবাদ কাহিনীর মতো আর সাহস ছিলো সীমাহীন। এককথায় তিনি ছিলেন জিতেন্দ্রিয় মুক্ত পুরুষ। বুদ্ধি ছাড়া অন্য কোনো বৃত্তির বশ্যতা স্বীকার করেন নি কখনো। তিনি সর্বস্তরের মানুষের অশেষ শ্রদ্ধাভাজন হয়েছিলেন। তাকে পুরোদস্তুর স্বশিক্ষিত দার্শনিক বলা যায়। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সামাজিক মানুষ। তাঁর জীবনের প্রায় সবটাই কাজ। তাঁর চিন্তাও এইদিক থেকে কাজ। এথেনীয় সমাজক্ষেত্রে প্রয়োগসম্ভাবনা বাতিল করে তিনি কোনোকিছুই ভাবতে চাননি।
জ্ঞান ও কর্ম
সক্রেটিসের একটা বড়ো শিক্ষাই হলো জ্ঞান ও কর্ম এক অর্থাৎ জ্ঞান যদি কর্মে রূপান্তরিত না হয় তাহলে তাকে জ্ঞান বলাই যাবে না এবং যদি কর্ম জ্ঞান ব্যতিরেকে হতে থাকে, তাহলে তা অকর্ম বা দুষ্কর্ম। দার্শনিক বলতে যে আকাশচারী, স্বপ্নভুক, এলোমেলো, অপ্রস্তুত, বিপর্যস্ত, আধপাগলা মানুষের ধারণার চল আছে, অন্তত তার মূর্তিমান প্রতিবাদ। তাঁর পোশাক ছিলো নোংরা এলোমেলো, চলাফেরা ছিলো হাস্যকর, আবার আচরণও হয়তো অন্যদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হতো না। কিন্তু এর সবটাই একেবারে বাইরের ব্যাপার। এথেনীয় সমাজের পুরোদস্তুর কাজে লাগাটাই তাঁর সমস্ত জীবনের সাধনা ছিলো।
মাংস ভেদ করে সাপের কামড়ের মতো সক্রেটিসের কথা মানুষের আত্মায় প্রবিষ্ট হতো। ‘সক্রেটিস এবং মেনো’, কথপোকথনে মেনো বলেছেন:
আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে আমাকে বলা হয়েছিল যে আপনি নিজেকে এবং অপরকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কিছুই করেন না। এখন আমি সত্যিই ভাবি যে আপনি আমাকে মোহগ্রস্ত করেছেন এবং আমার উপর নানারকম ভেলকিবাজির জাল বিস্তার করেছেন যাতে আমি সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ি। যদি একটু মজা করার অনুমতি পাই, তাহলে বলতে পারি শুধু আকারে নয়, অন্যান্য ব্যাপারেও টর্পেডো-মাছের সঙ্গে আপনার বড়োই সাদৃশ্য আছে। টর্পোডো-মাছের কাছে গেলে বা তাকে স্পর্শ করলে শরীর বিবশ হয়, আপনার কাছে এসে আমারও তাই হয়েছে।
আমার আত্মা এবং ঠোঁট দুখানি আক্ষরিকভাবে বিবশ এবং জানি না আপনাকে আমি কি জবাব দেবো। ভালো বা কল্যান সম্পর্কে আমি অনেক বক্তৃতা করেছি, বড়ো বড়ো সমাবেশে। এবং আমার ধারণামতো খুবই সাফল্যে সঙ্গে। কিন্তু এখন আমি বলতে পর্যন্ত পারি না, আমার ঐ বক্তৃতা কি বস্তু। আপনি যে কোথাও যান না, কখনো দেশ ছাড়েন না, মনে করি সেটা আপনার সুবিবেচনার কাজই হচ্ছে। কেননা বিদেশে একজন বিদেশী হিসেবে এইসব কাণ্ডকারখানা করলে যাদুকর বলে আপনি অচিরেই আটক হতেন।
এই সাক্ষ্য থেকে আমাদের বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ মানুষ।।
সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি
সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি হলো: ‘সুদগুণ ও জ্ঞান অভিন্ন’ বা সদগুণই জ্ঞান (Virtue is knowledge) ! সদগুণ = ভালোত্ব, উত্তম ও শ্রেয় । জ্ঞানের সঙ্গে ভালোত্বের অভিন্নতার কথা বলার অর্থই হচ্ছে, ভালোত্বের জ্ঞান ছাড়া জীবনে ভালোত্ব অর্জন করা সম্ভব নয় এই কথা বলা। এ পর্যন্ত কথাটা বেশ বোঝা যায়। কিন্তু এর পরেই সক্রেটিস বলেন, ভালোত্বের জ্ঞান ছাড়া যখন ভালোত্ব অর্জন করা যায় না, তখন ‘মন্দ’ যারা করে তারা নিশ্চয়ই ইচ্ছাকৃতভাবে ‘মন্দ’ করে না, ভালোত্বের জ্ঞানের অভাবেই করে। ‘মন্দ’ তাহলে এক ধরণের অজ্ঞানতা। কথাটাকে প্রথম দৃষ্টিতে সাদামাটা বলেই মনে হয়। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারা যাবে এই বক্তব্য সত্যই অসাধারণ।
ভালোত্বের জ্ঞান থাকলে মানুষ ভালো করবে একথাটা তেমন নতুন নয়, কিন্তু ভালোত্বের জ্ঞান যে মানুষের আছে, সে মানুষ মন্দ করতেই পারে না, সে মানুষ ভালো করতে বাধ্য, যদি মন্দ করে তাহলে বুঝতে হবে তার ভালোত্বের জ্ঞান সত্যকার জ্ঞানের পর্যায়ে ওঠে নি, এ কথাটা কিন্তু নতুন। সক্রেটিস বলতে চান, মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে মন্দ করে না, করে অজ্ঞানতা থেকে।
এমনকি তিনি এ পর্যন্ত বলতে চান যে ভালোত্বের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও যে মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে মন্দ করে, সে মানুষ অনিচ্ছাকৃতভাবে মন্দকারীর চেয়ে ভালো। কেননা প্রথম ব্যক্তি জ্ঞানী না হলেও অসম্পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী, কিন্দু দ্বিতীয় ব্যক্তি সম্পূর্ণত অজ্ঞান, তার কোনো আশাই নেই। যে মানুষ ভালো এবং মন্দ কি তা জানে, সে ইচ্ছে করে মন্দকে পছন্দ করতে পারে না।
রিভিউ পড়ুন : আগুনপাখি: রক্তক্ষরণ ইতিহাসের এক শিল্পিত দলিল
সক্রেটিস এ বিষয়ে পুরোদস্তুর নিশ্চিত ছিলেন যে, ‘প্রকৃত দুর্ভাগ্য একটি- মন্দ করা এবং প্রকৃত সুখও একটি- ভালো করা। সাধারণভাবে ‘কোন মানুষই নিজেকে অসুখী করতে চায় না, বা নিজের ক্ষতি ডেকে আনতেও চায় না, অতএব কোন মানুষই স্বেচ্ছায় মন্দ করবে না।’ ভালোত্ব ও জ্ঞান অভিন্ন এবং ভালোত্বের জ্ঞানের অর্থই হচ্ছে বাস্তবে ভালো করা। এ পর্যন্ত যদি মেনে নেওয়া যায়, তাহলে বলতে হয়, ‘কোনো মানুষেরই মন্দ করা উচিত নয়, শত্রুর প্রতিও নয় এবং মন্দ করা থেকে বিরত থাকার জন্যে যে কোন দুঃখ কষ্ট, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত বরন করে নেওয়া উচিত।
‘এ্যাপোলজি’তে সক্রেটিস বলেন:
এথেন্সবাসিগন, আমি আপনাদের সম্মান করি এবং ভালোবাসি; কিন্তু আমি বরং ঈশ্বরকে মেনো চলবো, আপনাদেরকে নয় এবং যতোক্ষণ আমার দেহে প্রাণ আছে আমি দর্শন চর্চা ও শিক্ষা দেয়া থেকে বিরত হবো না; যার সঙ্গে দেখা হবে তাকেই পরামর্শ দেব।
সক্রেটিস তাঁর ভাষণের শেষ দিকে যে সমস্ত বিচারক তাঁর পক্ষে রায় দিয়েছিলেন তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেন:
যাঁরা মৃত্যুকে অশুভ বা মন্দ বলে তাঁরা ভুল করে। মৃত্যুর পরে যদি মুসিউস, হিসয়েড আর হোমারের সঙ্গে আলাপ করতে পারা যায় তা হলে তার জন্যের মানুষ কি না দিতে পারে? এইটাই যদি সত্য হয় তা হলে আমি বারে বারে মরতে চাই। পরলোকে অন্তত প্রশ্ন করার অপরাধে মানুষকে হত্যা করা হয় না।…বিদায় নেবার সময় এসে গেছে, আসুন নিজের নিজের রাস্তায় চলি আমরা-আমি মরতে এবং আপনারা বাঁচতে। ঈশ্বর জানেন কোনটা বেশি ভালো।
সক্রেটিসের পরিনতি
সক্রেটিসকে হেমলক বিষপানে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল 399 খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। তখন তাঁর বয়স সত্তরের একটু বেশি।
সক্রেটিস সম্পর্কে উক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা হাসান আজিজুল হক এর ‘সক্রেটিস’ নামক বই থেকে নেওয়া হয়েছে। সক্রেটিস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে মাত্র 64 পৃষ্ঠার বইটি সচেতন পাঠকগন অবশ্যই পড়বেন।