Site icon Gohine Dola

সিড়ি ভেঙে ভেঙে: উত্তেজনাহীন হৃদয় কাঁপানো থৃলার উপন্যাস

সিড়ি ভেঙে ভেঙে

সিড়ি ভেঙে ভেঙে একটি উত্তেজনা বিহীন থৃলার উপন্যাস। বরাবরের মতই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পাঠক ধরে রেখেছেন উপন্যাসের শেষ অবধি।

সিড়ি ভেঙে ভেঙে রিভিউ

অহংকারী বাসুদেবের ফ্ল্যাট আটতলায়। লিফট সার্ভিসিংয়ের কাজ চলছে। ঠিক হতে দু তিন ঘন্টা লাগবে। আজ নাও হতে পারে। বাসুদেব চিন্তিত হলেন। হার্ট ভাল নয় তার। উচিত হবে কি সিঁড়ি বেয়ে ওঠা? যৌবনে ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাবে ফুটবল এবং ক্রিকেট দুই-ই খেলেছেন। এখনও দেওয়াল আলমারি ভর্তি তাঁর খেলার ট্রফি। অহংটা মাথাচাড়া দিল। পারবেন না? তাই কি হয়? মাত্র ছেষট্টি বছর বয়স। শরীর নিয়ে তাঁর অহংকার আছে। মাস চারেক আগে হার্টের গণ্ডগোল ধরা পড়েছিল, কিন্তু সেটা তেমন দুশ্চিন্তার কিছু নয়। অন্তত তিনি মনে করেন না।

একটা তলা উঠে এলেন বাসুদেব। কোনও অসুবিধে হল না। আস্তে আস্তে উঠলে অসুবিধে হওয়ার কথাও নয়। উঠতে উঠতে তিনি নিজের প্রবল অহংকারের কথাই ভাবছিলেন। অহংকারীরা একটু স্বার্থপর হয়েই থাকে। এবং তারা অন্যের সম্পর্কে উদাসীন। এই স্বার্থপরতা আর উদাসীনতা কত নির্মম হতে পারে তার উদাহরন এই গল্পের রীনা আর শঙ্কর। স্বামী-স্ত্রী তাঁরা। বাসুদেব এই দম্পত্তিকে ভাল করে দাম্পত্য জীবন যাবন করতেই দেননি। রীণা বাসুদের একজন ভক্ত ছিল।
রীণা ছোটোখাটো, রোগা, মুখখানা ভারী মিষ্টি, মায়াবী চোখ দুখানা ছিল গভীর রহস্যে ভরা। নম্র শরীর আর মাজা রং। রাণী যখন বাসুদেবের প্রেমে পড়ে তখন রীণার বিয়ে হয়ে গেছে শঙ্করের সাথে। আর বাসুদেব শুধু বিবাহিতই নন, দুই ছেলেমেয়ের বাবাও। কিন্তু রাণী আর বাসুদেব এমনভাবে পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেলেন যেন, তাঁদের বয়ঃসন্ধি। দেহ তো ছিলই, দেহ ছাড়িয়েও অনেক দূর গড়াল সম্পর্ক। শঙ্কর বড় একজন ইঞ্জিনিয়ার। কাজের সূত্রে নানা জায়গায় ট্যুর থাকত। বাসুদেব রীণা সেই সুযোগ নিতেন না তা নয়। বরং বাসুদেব শঙ্করকে বলে দিয়েছেন তুমি রীণাকে ডিভোর্স করো, ওকে আমার চাই। রীণাও স্পষ্ট ডিভোর্স চেয়েছিল শঙ্করের কাছে।
বেচারা শঙ্কর। সে এমনই হদ্দমুদ্দ ভালবাসত রীণাকে যে প্রস্তাব শুনে প্রথমটায় রেগে গেলেও তাঁদের আটকানোর উপায় না দেখে পাগলের মত হয়ে গেল। তখন রীণাকে বলেছিল, যা খুশি করো, কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি বাসুদেবের সাথে তোমার সম্পর্ক মেনে নিচ্ছি। শুধু কথা দাও, আমাকে ছেড়ে যাবে না। রীণা শঙ্কর আর বাসুদেবের সাথে সম্পর্ক চলমান রাখল। শঙ্কর কখনও আর অস্ফুট প্রতিবাদও করেনি। রীণা শঙ্করের সাথে চুক্তি করে নিয়েছিল, তার প্রথম সন্তানটি হবে বাসুদেবের। শঙ্কর মেনে নেয়। বাসুদেব আর রীণার সন্তান হল অজাতশত্রু। অজাতশত্রু জানে না যে বাসুদেব তার পিতা। সে জানে তার বৈধ পিতা শঙ্কর। [সিড়ি ভেঙে ভেঙে]বাসুদেব চারতলায় উঠলেন। তাঁর হাঁফ ধরে যাচ্ছে, জিরোতে হবে। মিনিট পাঁচেক নির্জন সিঁড়ির চাতালে দাঁড়িয়ে রইলেন। পাচঁতলা পেরোবার আগেই বাসুদেবকে আবার থামতে হলো। ফের শ্বাসটায় টান পড়ছে। ঘাম হচ্ছে। হাঁফ ছাড়তে লাগলেন, চোখটায় একটু ঘোলাটে দেখছেন। শরীর বেশ দুর্বল লাগছে। ছয়তলায় এসে বুকের মাঝখানে ব্যথাটা টের পেলেন। চোখের সামনে অন্ধকার পর্দার কিছু দেখতে পাচ্ছেন। ভয় পেয়ে গেল। হার্টের রোগী এরকমন হলে শুয়ে পড়তে হবে ডাক্তার বলেছিল। কিন্তু বাসুদেব সেনগুপ্ত তার অহং যে এখনও মরেনি। তিনি অসহায়ের মতো সিঁড়িতে শুয়ে পড়লে লোকে হাসবে যে। ছটা তলা পেরিয়ে এসেছেনে। সাত পেরিয়ে আট-এ উঠে যেতে পারলে আর ভাবনা কি। কিন্তু আরও দুটো তলা যেন এভারেস্টের মতো উচুঁ মনে হচ্ছে এখন। বাসুদেব চোখে আলো আধারী দেখছেন। বুকের ব্যথা বাড়ছে। মাথা টলে যাচ্ছে। হাত পা শিথিল আর শীতল হয়ে যাচ্ছে। তিনি প্রাণপণে ডাকতে চেষ্টা করলেন তার স্ত্রীকে, শিখা! শিখা! শিখা!… [সিড়ি ভেঙে ভেঙে]সিঁড়ি দিয়ে কে নেমে আসছিল। চেঁচিয়ে বললেন, বাঁচাও..
যে নেমে এল তার মুখটা চিনতে পারলেন বাসুদেব। তাঁর দিকে চেয়ে আছে। বাসুদেব হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। ধরো আমাকে ধরো। সে ধরল না। ধীর পায়ে নেমে গেল পাশ কাটিয়ে। বাসুদেব গড়িয়ে পড়লেন সিঁড়িতে। চোখে যবনিকা নেমে এল। [সিড়ি ভেঙে ভেঙে]

বাসুদেবের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লো। মৃত্যু সংবাদটা গোয়েন্দা এসএপি শবর দাসগুপ্ত পেল সকালে। বাসুদেবের মৃত্যুটা কি স্বাভাবিক ছিল নাকি চক্রান্ত ছিল তা বের করতে শবর তদন্তে নেমে পড়লেন। পুলিশি কর্তৃব্য ছাড়াও বাসুদেব শবরের দুর সম্পর্কের আত্মীয়, তাছাড়া একসাথে খেলাদুলা করেছেন। হার্টের রোগী বাসুদেব কেন লিফট ছাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেল সেসব বিষয়ে বাসুদেবের স্ত্রী শিখা’সহ দাড়োয়ান ও অন্যন্যকে প্রশ্ন করতে লাগলেন। শবর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে বের করে আনলেন বাসুদেবের জীবন যাপনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বার্থপরতা ও স্বেচ্ছাচারিতার লোমহর্ষক কাহিনী। [সিড়ি ভেঙে ভেঙে]

বাসুদেব মারা গেলে শঙ্করের লাভ, অজাতশত্রুর লাভ আছে। রীণাও খুন করতে পারে পুরনো স্মৃতি ভুলতে। বাসুদেবের ভাইপোরা সম্পদ আত্মসাতের জন্য হত্যার হুমকিই দিয়েছিল। সন্দেহের তালিকায় সবাই। আসল খুনিকে কি গোয়েন্দা এসএপি শবর দাসগুপ্ত বের করতে পারবে? শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মাত্র 97 পৃষ্ঠার এই দুর্দান্ত “সিড়ি ভেঙে ভেঙে” উপন্যাসটি পড়লে জানতে পারবেন আসল রহস্য।

Exit mobile version